দু-চাকায় এবার Darjeeling।। ঋতুরাজ পাত্র

‘দুরন্ত ঘূর্ণির এই লেগেছে পাক।

এই দুনিয়া ঘুরে বনবন বনবন

ছন্দে ছন্দে কত রঙ বদলায়

রঙ বদলায়’।

হ্যাঁ ঠিক এই গানটাই মাথায় আসছিল যখন আমরা বংকার’স অন হুইল থেকে প্রথম বার একটু লং রাইডের কথা ভাবছিলাম। কারণ আমাদের কাছে দুনিয়াটা এরকমই চষে বেড়ানোর জন্যে। আমাদের জন্যেই যেন দু-চাকার ডানা ঈশ্বর বানিয়ে পাঠিয়েছেন মনের মতো করে।

তবে ঘুরতে যাওয়ার আগে প্রস্তুতি অবশ্যই থাকে। আর আমাদের সবাই যে যার মতো রেডি। আগামীকাল সকালে কলকাতা থেকে আমরা বংকারস অন হুইলস টিম পাড়ি দেবো দার্জিলিং-এর উদ্দেশ্যে। আর তাই আমি এখন যাচ্ছি ব্যারাকপুরে আমাদের আরেক সদস্য পার্থ’দার বাড়িতে। তারপর সেখান থেকে হুসস…

কোভিড সিচুয়েশন আমাদের অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে গত বছর থেকে। সেভাবে কোথাও বেরোনো হয়নি অনেকদিন। পার্থ দা’র বাড়িতে পৌঁছনোর পর শেষ মুহুর্তে সবকিছু চেক করে নেওয়ার পালা। ভোর ৩টের সময় আমাদের জার্নি স্টার্ট করবার পালা। তৈরি হয়ে এবার অপেক্ষা করছি আমাদের বাকি রাইডারদের জন্যে। ভেতরে একটা কেমন উত্তেজনা হচ্ছে। ঠান্ডা সেভাবে না পড়লেও এই ভোর ভোর সময়ে শরীর কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। ৫৬২ কিলোমিটার পথ আমরা আমাদের এই দু চাকার উড়ানকে নিয়ে উড়ব। তবে আমাদের প্রত্যেকের বাইকেরই একটা করে নাম আছে। বলি সেগুলো, ক্রুসো, ড্রাঞ্জার, গোল্ডি, পক্ষীরাজ, সিলভারব্লেজ, থানোস।

জার্নির শুরুতেই একটু চাপ হয়ে গিয়েছিল আমার বাইক নিয়ে। তবে সে চাপ কাটিয়ে শুরু হল আমাদের কলকাতা থেকে দার্জিলিং ট্যুর। আমার সামনে আছে শ্রিয়া দি আর পার্থ দা। আর তাঁদের সামনে আছে সায়ন। ঘড়ির সময় বলছে ৩টে বেজে ৪৯। যদিও ৩টের সময় বের হওয়ার কথা ছিল, একটু লেট হয়ে গেল। ঠান্ডা কম লাগলেও আছে একটু।

ব্যস আমাদের জার্নি স্টার্ট। ব্রেকফাস্টের জন্য দাঁড়ালাম একটা জায়গায়। সকালের ওয়েদারটা একটু খারাপ হওয়ার জন্যে এতক্ষণে ৯৫ কিলোমিটার এসেছি। এই সকালেই যতটা সম্ভব দূরত্ব যেতে হবে টানা। মাঝখানে পেট্রোলের জন্যে একটু হল্ট নেওয়া হল। নেক্সট হল্ট মৌরগ্রামে।

দশটার কিছু আগে মৌরগ্রামে পৌঁছে কিছু খাওয়া দাওয়া করা। সন্ধেবেলার আগে পৌঁছে যাব। এবার কিছু খেয়ে নেওয়া যাক, খিদেয় পেটে ইঁদুর দৌড়চ্ছে। পরবর্তী স্টপেজ ফরাক্কা নাহলে মালদা। আমরা ১১টা ৪৫-এ ফরাক্কা পৌঁছই। রাস্তা কিছুটা খারাপ। একটু ভিড়ও আছে। এখানে না দাঁড়িয়ে মালদায় দাঁড়ানো হবে ঠিক করা হল। এবার কিন্তু বেশ গরম লাগতে শুরু করছে। ফরাক্কা ব্যারেজে বেশ জ্যামের মুখে পড়লাম। সেসব কাটিয়ে লাঞ্চের জন্য মালদা পেরিয়ে রায়গঞ্জে দাঁড়ালাম।

এরপর আর কোথাও দাড়াইনি আমরা। শিলিগুড়ির কাছে এসে পার্থদার গাড়ি একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। টায়ার পাংচার হয়ে গেছে। এখনও ৯১ কিলোমিটার রাস্তা যেতে হবে, তাই এখন ঠিক না করলে সমস্যা হবে। শিলিগুড়িতে পৌঁছে আমাদের দ্বিতীয় দিনের জার্নি শেষ হবে।

অবশেষে বেশ কিছু অ্যাডভেঞ্চারস, গর্ত, ডানকুনি, রায়গঞ্জ ট্রাফিক, আর গুগল ম্যাপের গন্ডগোল নিয়ে  শিলিগুড়ি এসে পৌঁছই। শিলিগুড়িতে আমরা উঠেছিলাম গোল্ডেন গার্ডেন নামে একটা লজে। তবে এটা লজ না বলে রেস্টুরেন্ট বলা ভালো।

আমাদের জার্নির তৃতীয় দিনে শিলিগুড়ি থেকে আমরা যাবো কার্শিয়ং। তারপর ঠিক করব কোথায় যাওয়া যায়। শিলিগুড়িতেই পার্থদার বাইকের টায়ার ভালো করে সারিয়ে নেওয়া হল পাহাড়ে ওঠার আগে। হোটেল শিমলায় ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরোলাম এবার। কাছাকাছি একটা পেট্রল পাম্প থেকে তেল ভরে নেওয়ার পর শুরু হল আল্টিমেট জার্নি টু হিল।

রাস্তায় ছবি তোলার জন্যে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অবশেষে পাহাড়ি রাস্তায় পৌঁছলাম। পাহাড়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেদের সেই গন্তব্যের দিকে নিয়ে চললাম। এই জার্নিতে একটুও ক্লান্তি নেই আমাদের। আর ফুরফুরে হাওয়ার সঙ্গে গতির মিশ্রণ, আহা জীবনে আর কি চাই…

এরই মধ্যে কার্শিয়ং-এ ঢুকে গেলাম আমরা। এবার এখানে খুঁজতে হবে আমাদের হোটেলটা কোথায়। চারদিকের সবুজ পাহাড়ি রাস্তা আর সূর্যের আলো, কি যে ভালো লাগছিল। আগে একবার এসেছিলাম, কিন্তু সেবার কার্শিয়ং ঘোরা হয়নি। কার্শিয়ং স্টেশনে দাঁড়িয়ে দেখলাম পার্থ দা দাঁড়িয়ে আছে। টয়ট্রেন আসছিল। তবে আমাদের সৌভাগ্য হয়নি তার পাশে পাশে চলার। একটু ভুল রাস্তায় চলে যাওয়ার কারনে আবার এগিয়ে গিয়ে টার্ন নিয়ে আমরা ফেরত এলাম। এখানেই আমাদের আজকের ঠিকানা। এখানে গাড়ি রেখে একটু ঘুরতে বেড়োব আমরা। হোটেলে পৌঁছে একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম। রুম থেকে ভিউটা বেশ দারুণ। এখানে একটা ছোট্ট বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বাথরুম, রুম চেক করে নেওয়ার পর কমপ্লিমেন্টরি লাঞ্চ চলে এলো আমাদের জন্য।

লাঞ্চের পর আশেপাশের জায়গা গুলো ঘুরে দেখার জন্যে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আবার। কার্শিয়ং-এ একটা বড় হনুমান জ্বী’র মন্দির আছে সেখানে যাব। খাঁড়া পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে চলতে বেশ দারুণ লাগছিল। আর সাইড ভিউ কি দুর্দান্ত। না এলে বোঝাই যেত না। আসলে অনেকদিন পর বংকারস বেরিয়েছে এক্সপ্লোর করতে। ‘I love kurseong’ লেখার সামনে চলছিল ফোটোগ্রাফি। এখানে পৌঁছে মন একেবারে গার্ডেন গার্ডেন হয়ে গেল। এখানে যতদূর চোখ যায় চায়ের বাগান শুধু। এখন দিনের আলো কমে আসার দিকে। তাই আজ আর মনে হয় না কোথাও যাওয়া যাবে। পার্থ দা অনেক আগে এগিয়ে গেছে। নবীন দা আমার পাশে পাশে চলছে। বেশ ঠান্ডা। এবার নিচে যাওয়ার পালা। আজ আর অন্য কোথাও না হোটেলে চলে যাওয়াই ঠিক বলে মনে করলাম।

কার্শিয়ং থেকে আমরা চতুর্থ দিন ঈগলস কাট দেখতে গেলাম। সকালে উঠেই সমস্যা, আমার ফোন কাজ করছিল না। কি আর করা যাবে। হেঁটে হেঁটে আমরা পৌঁছলাম ঈগলস ভিউ-এ। এটা ৯টায় খুলবে বলে যাওয়া হল না। এবার আমরা দার্জিলিং যাব। এরপরের স্টপেজ ডাউহিল। এই রাস্তাটা জঙ্গলে ভর্তি। দুর্দান্ত লোকেশন আর রাস্তাও বেশ সুন্দর। রোমাঞ্চকর লাগছিল পুরো ব্যাপারটা। জঙ্গলের ভেতর আমরা একবার দাঁড়ালাম ছবি-টবি তোলার জন্য। ডাউহিলের ডিয়ার পার্কে পৌঁছে আমরা বাইক দাঁড় করালাম। এখানে একটু ঘোরাফেরা হবে। এখানে একটু ঘুরে আমরা চিমনি হেরিটেজ নামে একটা জায়গা দেখে নেওয়া। এখান থেকে এবার দার্জিলিং-এ পৌঁছে লাঞ্চ।

রাস্তা খারাপই ছিল। এই রাস্তায় একটু ঢাল আছে, এখানে এক জায়গায় লেখা আছে, বাইকের ইঞ্জিন এবং ব্রেন যেন বন্ধ না করা হয়। ঢালের রাস্তায় যেতে যেতে বেশ ভয়ও করছিল খানিকটা। আমার বাইকে একটু সমস্যা হয়ে গিয়েছিল, সেটা হল ব্রেক ফেল হয়ে গেছে পেছনের চাকার। তার জন্যে যেতে হবে ৭-৮ কিলোমিটার।

দার্জিলিং-এ পৌঁছে ম্যাল রোডে ঘুরে বেড়ানো। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউটা বেশ ভালো দেখতে। আগের বার যে হোম স্টে-তে উঠেছিলাম সেখানেই আবার উঠেছি। আমরা এখান থেকে যাব বাতাসিয়া লুপ, এরপর বাম্বু কটেজ। যেখানে আমাদের বুকিং করা আছে, ওখান থেকে আবার এখানে ব্যাক।

বাইরে বেশ রোদ ঝলমলে আবহাওয়া। সবাই রেডি বেরনোর জন্যে। এখানে কিছুটা অফ রোডিং করতে হল বেশ অনেকটা পথ।  নবীনদা’র গাড়িটা ভারী, চাকা স্কিড করছিল। তবে সেটা কাটিয়ে উঠে এগোলাম। পথ ভুল হওয়ার জন্যে আবার কিছুটা সময় গেল। এবার আমরা দার্জিলিং স্টেশনে পৌঁছে গেছি। এখানে শ্রিয়া দি আর মীনাক্ষী। ওরা আগেই হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেছে। এখান থেকে এবার একসঙ্গে যাব বাতাসিয়া লুপ।

রাস্তার ধারে পার্কিং করে আমরা গরম গরম মোমো খেলাম। ওয়েদার বেশ ভালো। কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ এত ভালো সব জায়গা থেকে দেখা যাচ্ছিল আজ। আমাদের লাক এতটাই ভালো টয়ট্রেন দেখতে পেলাম দুটো। ট্রেনে একটু উঠেও গেলাম। বাকিরা ছবি তুলতে ব্যস্ত। এখানে সব দেখা হয়ে যাওয়ার পর আমরা ঘুম স্টেশন হয়ে ব্যাম্বু রিট্রিটে পৌঁছব এক দেড় ঘন্টার মধ্যে। টয়ট্রেন দেখতে দেখতে সেই গানটার কথা মনে পড়ে গেল… ‘কস্তো মজা হ্যায় লেলাইমা… রমালো ও কালি ওধালি…’ এখানকার বাচ্চাগুলো সব লাল টুকটুকে গাল নিয়ে কি মিষ্টি হাসে। আহা, দেখেই মন ভালো হয়ে যায়।

ব্যাম্বু রিট্রিটে যাওয়ার সময় ভিউটা বেশ দারুণ ছিল। দার্জিলিং-কে নতুন করে এক্সপ্লোর করতে আমরা চা বাগানের ভেতর দিয়ে যেতে শুরু করলাম। সামনে একটা স্কুল রয়েছে। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। চা বাগান পাহাড় এক জায়গায় মিশে গেছে। এরপর শুরু হল অফ রাইড। অন্ধকার হয়ে গেছে প্রায়। পড়ে যেতে যেতে আমাদের সবার গাড়িই কিছু না কিছু খারাপ হয়ে গেছে। এত খারাপ রাস্তা যে তাই আমরা আবার ফিরলাম আমাদের কটেজে। একটু অ্যাডভেঞ্চার যদি চান আপনারা আসতেই পারেন এখানে। কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ ছিল এবার বেশ ভালো। এটা আমাদের লাক বলতে গেলে। আগামীকালের প্ল্যান হল ত্রিবেণীর ক্যাম্পিং।

এই ক্যাম্পিংটাই সব থেকে মজার ছিল আমাদের কাছে। ত্রিবেণীতে আমাদের ক্যাম্প। নদীর পাশেই সবার তাবু খাঁটিয়ে এখানেই থাকা। ভীষণ সুন্দর আর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বলতে গেলে। তিস্তা আর রঙ্গিত নদীর মিলনে এই জায়গাটা। নদীর জলটা একেবারে নীল। এখানে ব্রেকফাস্ট, চা খাওয়া আর চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করা। বোটিং করা হবে কি না সে নিয়ে সবার মধ্যে চলছিল আলোচনা। লুচি, আলুর দম, ঘুগনি খাওয়া।

বেশ একটা রোমাঞ্চকর জার্নি হল এবার। রাফটিং করার ইচ্ছে ছিল। পরে কখনো হবে। আপনারা যদি রাফটিং করতে চান, ২০০ টাকায় উপর থেকে নিচে রাফটিং করতে পারেন। দার্জিলিং ট্রিপের শেষটা বেশ ভালো লাগল আমাদের। এবার আমাদের ফেরার পালা। বংকারস অন হুইলস-এর দার্জিলিং ট্রিপ। সবটা প্ল্যানিং মতো না হলেও গোটা ট্রিপটাই ছিল অ্যাডভেঞ্চারাস।

** আপনাদের জন্য সমস্ত ডিটেলস রইল ইউটিউব লিংক-এ। যেখান থেকে আপনারাও পেয়ে যাবেন সমস্ত তথ্য।

#lost with raj #Partha – Wandering the Mile #Bonkersonwheels  #Adventure #mountains #Darjeeling #outskirts #Suzuki #gixar #yt #mountains #ride #travel #vlog #BOW #Bonkersonwheels 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *