‘ট্রেকিং’ শব্দটি শুনলেই শরীর ও মন জুড়ে যেন একটা রোমাঞ্চের স্রোত বয়ে যায়। তবে অনেকেই এমন আছেন যাদের কাছে এই চিত্রটা সম্পূর্ণ বিপরীত, ট্রেকিং-এর নাম শুনলেই ভয়ে আঁতকে ওঠেন তারা। তাদের বলি এতে আঁতকে ওঠার মতো কিছু নেই। একবার যদি আপনি ট্রেকিং-এর স্বাদ পেয়ে যান, সেই নেশা থেকে দূরে থাকা মুশকিল। আসলে আমাদের অনেকেরই ধারণা যে, ট্রেকিং ভীষণই কষ্টসাধ্য –এই ধারণা একেবারেই ভুল। এটা ঠিক যে সব ট্রেকিং রুট সকলের যাওয়ার জন্য ঠিক নয়, তবে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে এমনও কিছু ট্রেক রুট রয়েছে যেখানে খুদে থেকে বয়স্ক, সকলেই সাক্ষী থাকতে পারবেন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের। পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়তো আপনার আছে, কিন্তু কাছ থেকে পাহাড়ের হৃদস্পন্দন অনুভব করতে হলে আপনাকে হাঁটতেই হবে চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে। জঙ্গল, পাহাড়, ঝর্ণা, বাহারি ফুল, গাছপালায় ভরা নিরিবিলি পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আপনার দৃষ্টিপটে ধরা দেবে তুষারধৌলী পর্বতশৃঙ্গ কিংবা স্বচ্ছ নীলাভ হ্রদ, সেই অপার সৌন্দর্যের কাছে তখন বাকরুদ্ধ হয়ে দুর্গম পাহাড়ি পথটিকে নেহাত ফিকে লাগবে। তবে শুধু তো ট্রেকিং করব বললেই চলবে না, চাই প্রপার গাইডেন্স। অদ্বিতীয়ার পক্ষ থেকে রইল ট্রেকিং-এর যাবতীয় গাইডলাইন। এগুলি মেনে খুশির পাখনা মেলে বেরিয়ে পড়ুন আপনার স্বপ্নের শিখরের উদ্দেশে।
ট্রেকিং বিগিনারদের মনে রাখার বিষয়
যারা প্রথমবার ট্রেকিং করবেন বলে ভাবছেন, সহজ কোনও ট্রেক রুট বাছুন। অ্যাডভেঞ্চারের তাগিদে শুরুতেই কঠিন কোনও পাহাড়ে চড়া ঠিক নয়। এক্ষেত্রে দু-তিনবার ট্রেকিং-এর অভিজ্ঞতা অর্জনের পরই মডারেট কোনও ট্রেক রুট প্ল্যান করেতে পারেন। আগে কখনও ট্রেক করেননি বলে কোনওদিনই যে করতে পারবেন না তেমনটা নয়। পাহাড় ভালোবাসলে, প্রকৃতিকে আরও কাছ থেকে দেখতে চাইলে সহজ কিছু বিষয় মাথায় রাখলেই ট্রেকে যেতে পারবেন। বিষয়গুলি হল-
সহজ ট্রেক রুট বাছুন
- যেহেতু প্রথমবার ট্রেকে যাবেন, তাই কঠিন ট্রেক রুট ভুলেও বাছবেন না। অভিজ্ঞ ট্রেকাররা যে ধরণের ট্রেক রুট বাছেন, প্রথমেই সেগুলোতে যাবেন না। কঠিন ট্রেক আপনার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
ট্রেকে যাওয়ার জন্য আপনি ফিট কিনা যাচাই করুন
- ট্রেকিং ট্রিপ প্ল্যানিং-এর আগে প্রপার মেডিকেল চেকআপ মাস্ট। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কখনওই ট্রেকিং করতে যাবেন না। ট্রেকিং-এর সময় অনেকেরই সর্দি-কাশি কিংবা স্টমাক আপসেট হতে পারে। সাধারণ এই অসুখও আজানা পাহাড়ি পথে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। ট্রেক ম্যানেজারকে আপনার ঠান্ডা লাগার ধাত থাকলে বা পেটের অসুখের ধাত থাকলে আগে থেকে জানাতে ভুলবেন না। অন্য কোনওরকম শারীরিক অসুস্থতা থাকলেও অবশ্যই জানাবেন। পার্বত্য চড়াই পথে যদি আমাশয়, ফোসকা, মাথা যন্ত্রণা বা মাথা ঘোরার মতো সমস্যা দেখা দেয়, তৎক্ষণাৎ তা ট্রেক ম্যানেজারকে বা অভিজ্ঞ টিম লিডারকে জানান। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এমন গ্রুপের সঙ্গে ট্রেক প্ল্যান করবেন, যেখানে অবশ্যই ২-১ জন অভিজ্ঞ ট্রেকার থাকবেন। দলের প্রত্যেকেই যেন আনকোরা না হয়।
রিসার্চ নিয়ে নো-কম্প্রোমাইজ
- বিশেষ যত্ন নিয়ে ট্রেকিং-এর প্ল্যানিং করতে হবে। আপনার গন্তব্যে যাওয়ার অগে সেই জায়গা সম্পর্কে ভালো করে রিসার্চ করে জেনে নিন। একমাত্র প্রপার রিসার্চ করার পরেই লোকেশন ফিক্সড করুন। কতটা কঠিন সেই পথ, কত কিলোমিটার হাঁটতে হবে, ক্লাইমেট কেমন সেখানকার, বছরের কোন সময় ট্রেকিং-এর জন্য উপযুক্ত ইত্যাদি বিষয়গুলো খুঁটিয়ে জেনে নিন। মনে রাখবেন, অ্যাডভেঞ্চার খুবই ভালো কিন্তু নিরাপত্তা সবার আগে জরুরি।
অবশ্যই দরকার প্রপার শিডিউলিং
- যেকোনও অ্যাডভেঞ্চার প্ল্যান করার শুরুতেই যাত্রার বিস্তারিত একটা শিডিউল সেট করে নেবেন। তবে শিডিউল অবশ্যই সেট করবেন যেখানে যাচ্ছেন সেই জায়গার ক্লাইমেট এবং তৎকালীন রাজনৈতিক এবং ভৌগলিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই। নিকট কোনও আত্মীয় বা বন্ধুকে অবশ্যই জানিয়ে রাখবেন আপানার অ্যাডভেঞ্চার শিডিউলটি, যাতে আপনি কোনওরকম বিপদে পড়লে তারা সাহায্য পাঠাতে পারেন।
বাজেট তৈরিতে সতর্ক থাকুন
- যেকোনও প্রোগ্রামের ক্ষেত্রেই বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ট্রেকিং-এর ক্ষেত্রেও তা ভিন্ন নয়। তবে কোনও হিল স্টেশনে সাধারণ টুরিস্ট হিসেবে বেড়াতে যাওয়া আর অচেনা পাহাড়ি পথে পায়ে হেঁটে ভ্রমণ একেবারেই আলদা ব্যাপার। যেমন ধরুন, পাহাড়ে বেড়াতে গেলে আপনি ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুযোগ পাবেন, তবে ট্রেকিং-এর ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। একটা নির্দিষ্ট সীমানার পর সেই সুযোগ থাকবে না। তাই ট্রেক রুটে খাবারের দাম, থাকার খরচের জন্য খোঁজ নিয়ে মোটামুটি একটি ধারণা করে নিন। এক্ষেত্রে বাজেট তৈরির সময় একটু হাত খুলে হিসেব করুন। গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় বাজেটের থেকে কিছুটা বেশি টাকাই সঙ্গে রাখুন। ট্রেকিং ট্রিপে কাজে লাগতে পারে।
প্রয়োজনীয় যাবতীয় প্যাকিং করুন কেয়ারফুলি
যেহেতু আপনি একজন বিগিনার, সেহেতু কী ধরণের খাবারদাবার এবং জামা-কাপড় সঙ্গে নেবেন সে বিষয়ে ভালো করে খোঁজ-খবর নিয়ে নিন। হাঁটার পথে সেগুলি প্রয়োজন হলেও কিন্তু কিনে নিতে পারবেন না। যথেষ্ট পরিমাণে সঠিক খাবার এবং স্যুটেবল ক্লথস সঙ্গে নিতে হবে। খেয়াল রাখবেন, জামা-কাপড়ের কোয়ালিটি যেন ভালো হয়, রুক্ষ পাহাড়ি পথে হাঁটার সময় যা আপনি পরবেন। অন্যথায় সেগুলি ছিঁড়ে গিয়ে বিপত্তি হতে পারে। এই ধরণের ট্যুরে জামা-কাপড় কেচে পরার সুযোগও খুব বেশি পাবেন না, সেটাও মনে রাখা দরকার। তাই কুইক ড্রাই পোশাক নিলেই ভালো হবে।
আপনার রুকস্যাক প্যাক করার সময় যাবতীয় ইকুইপমেন্টস নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করে নিন প্রথমেই-
- হাঁটার সময় কী পোশাক পরবেন।
- কী কী ডে-প্যাকে বহন করবেন।
- ডাফেল ব্যাগে কোন জিনিসগুলি প্যাক করবেন।
ট্রেকিং এসেনশিয়ালস কোনগুলি?
মনোরম এবং রোমাঞ্চকর ট্রেকিং ট্যুর করতে গেলে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস অবশ্যই নিতে হবে সঙ্গে। নীচে কিছু জিনিসের তালিকা দেওয়া হল যা অতি অবশ্যই আপনাকে ট্রেকিং করাকালীন সঙ্গে রাখতে হবে।
- ওয়াটার প্রুফড ট্রেকিং বুটস।
- রানিং শ্যুস।
- ডাউন জ্যাকেট অথবা এমন কোনও পোশাক যাতে হুড আছে।
- একটি সোয়েটার যাতে বেশি ঠান্ডা লাগলে পরা যেতে পারে।
- দুটি কটন শার্টস।
- একজোড়া কটন ট্রাউজারস।
- তিনজোড়া ইনারওয়্যার।
- হুড যুক্ত উইনচিটার এবং রেইনকোট।
- সান হ্যাট।
- উলেন হ্যাট।
- উলেন গ্লাভস।
- সুতির মোজা।
- উলেন মোজা।
- নিজস্ব ফার্স্ট-এইড বক্স। সাধারণ অসুখ-বিসুখের ওষুধ যেমন- মাথা যন্ত্রণা, সর্দি-জ্বর, পেট খারাপ ইত্যাদি। এছাড়াও অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম, সার্জিক্যাল টেপ, মেডিকেটেড টেপ, সানস্ক্রিন লোশন, ব্লিস্টার থেকে সুরক্ষিত থাকতে নিন মোলেস্কিন।
- ওয়াটার পিউরিফাইং ট্যাবলেটস।
- টয়লেট কিট, যাতে থাকবে বাড়তি টাওয়েল।
- টয়লেট পেপার, স্যানিটাইজার এবং সোপ।
- একটি টর্চ এবং এস্কট্রা ব্যাটারি।
- সানগ্লাস।
- যথেষ্ট পরিমাণে জল ধরে এমন ওয়াটার বটল।
- পকেট নাইফ।
- প্লাস্টিক ব্যাগস।
- ওয়েট ডে-প্যাক।
- ওয়াটার প্রুফ ডাফেল ব্যাগ।
- ইনসেক্ট রেপেল্যান্টস।
ট্রেকিং-এর জন্য তৈরি করুন নিজেকে
- আপনার যদি একসঙ্গে অনেকটা পথ হাঁটার অভ্যাস না থাকে সেক্ষেত্রে অল্প দূরত্বের ট্রেক রুট নির্বাচন করুন। বিগিনারদের ক্ষেত্রে ট্রেকিং-এর সময় অবসন্নতা একেবারে কমন প্রবলেম। আপনিই একমাত্র, যিনি আপনার শারীরিক সক্ষমতা এবং সামর্থ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ওয়াকিবহাল, ফলে অন্যের কথায় নয়, নিজেই নিজের ট্রেকিং সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিন। নিজের সীমাবদ্ধতাগুলোকে প্রথমেই বিচার করুন। তাহলে ট্রেকিং-এর সময় কনফিডেন্ট থাকতে পারবেন সহজেই। মনে রাখবেন, বিগিনার হিসেবে ট্রেকিং-এর চূড়ান্ত উত্তেজনা এবং মুগ্ধতা আপনিই উপভোগ করতে পারবেন সবচেয়ে বেশি। আপনি যদি ট্রেকিং-এর মূল শর্তগুলো এবং গাইডেন্স ফলো করতে পারেন, তাহলে মনে রাখর মতো এমন একটি আশ্চর্য-সুন্দর ট্যুর আপনি কমপ্লিট করতে পারবেন, যা সারা জীবনেও ভোলা সম্ভব নয়।
ট্রেকিং-এর জন্য ১০টি টিপস
ট্রেকিং রুটে নিয়মিত অনেকটা চড়াই-উৎরাই পথ পাড়ি দিতে হয়, সেই সঙ্গে থাকে পাহাড়ি উচ্চতার ধকল। এই কারণে ট্রেকিং করার সময় এমন কিছু বিষয়ে তৈরি থাকা দরকার যাতে গোটা সফর শেষ করা যায় নিরাপদে এবং সবচেয়ে বেশি নিখাদ আনন্দ লাভ করতে পারেন। ট্রেকিং ইকুইপমেন্টস, নিউট্রিশন, হাইড্রেশন এবং স্পেসিফিক ট্রেকিং ট্রেনিং সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক। যাতে প্রথম দিনের হাঁটার পরই ব্লিস্টার বা পায়ে ব্যথার পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকতে না হয়।
কারেক্ট স্টেপ
- শুনতে অবাক লাগলেও এটা বাস্তব যে আপনি সম্ভবত ভুল হাঁটেন। আপনি যখন সমতলে হাঁটা-চলা করছেন, তখন সেটা হয়তো তেমন কোনও বিষয় নয়। কিন্তু পাহাড়ি এবড়ো-খেবড়ো পথে এবং উচ্চতায় সামান্যতম ভুল পদক্ষেপও আপনাকে ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক সমস্যায় ফেলতে পারে। পারফেক্ট স্টেপিং শিখে নিন। নিশ্চিত করুন পা ফেলার সময়।
প্রথমে যেন আপনার গোড়ালি ভূমি স্পর্শ করে। এরপর পড়বে আপনার পায়ের পাতা। প্রতিটি পরবর্তী স্টেপই পড়বে এইভাবে। এতে স্কিন স্প্লিন্টিস এবং টেনডন-এর বিপদ এড়ানো যাবে। মাথা উঁচু করে হাঁটুন। ঝুঁকে হাঁটবেন না। দুটি কাঁধ একই লেভেলে রাখতে চেষ্টা করুন।
আগেই নিন ট্রেকিং ট্রেনিং
- আপনি যদি ঠিক একবছর আগে ট্রেকিং-এর প্ল্যান করেন, তাহলে কিন্তু এখন থেকেই ট্রেক কন্ডিশনিং প্রোগ্রাম শুরু করার পক্ষে খুব বেশি তাড়াহুড়ো করা হবে না। অর্থাৎ এখন থেকেই শুরু করতে হবে নিজেকে প্রশিক্ষিত করে তোলার কাজ। স্ট্রেন্থ এবং ফিটনেস বাড়াতে হবে একটু একটু করে। নতুন যে চাহিদা আপনি শরীরের ওপর চাপাচ্ছেন তার সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নিতে দিন। এর ফলে আপনি যেমন ট্রেক ট্রেনিং উপভোগ করতে পারবেন তেমনই খুব তাড়াতাড়ি বিশাল কিছু করে ফেলার চেষ্টায় শারীরিক আঘাতের হাত থেকেও বাঁচবেন।
সঠিক জুতো নির্বাচন
- ভালো কোয়ালিটির এবং যথোপযুক্ত জুতো দরকার ট্রেকিং-এর জন্য। অ্যাঙ্কেল প্রোটেকশন সহ সাপোর্টিভ হাইকিং শ্যু খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সাবধান থাকুন অ্যাঙ্কল কাফস নিয়ে। খুব বেশি উঁচু অ্যাঙ্কল হলে আপনার কাফ (calf) বেস-এর অ্যাচাইলেস টেনডনে ইরিটেশন হতে পারে। নতুন ট্রেকিং বুট কিনে এখনই পরুন এবং হাঁটাহাঁটি করুন। ভালো করে খেয়াল করুন যে জুতোর মধ্যে আপনার পা দুটি যথেষ্ট কমফোর্টেবল ফিল করছে কিনা। মাথায় রাখুন, নতুন জুতোর ফোসকা যদি পড়ে, সেটা এখনই পড়া ভালো, ট্রেকিং-এর সময় নয়। একটু দুপুর-বিকেল নাগাদ বুট কিনতে চেষ্টা করুন, এসময় আপনার পায়ের পাতা কিঞ্চিৎ ফোলা থাকে। এতে আপনি কারেক্ট সাইজের বুট জুতো কিনতে পারবেন।
ওয়াকিং শকস ভুলবেন না
- আমরা জুতো নিয়ে যতটা মনোযোগী, ঠিক ততটাই অবহেলা করি মোজার বিষয়ে। ট্রেকিং-এর সময় কিন্তু বেস্ট কোয়ালিটির মোজা পরা দরকার। আপনার বুটজোড়া সঠিক হওয়া সত্ত্বেও যদি আপনি ভুল মোজা পরেন তাহলে আপনার ট্রেকিং বরবাদ হয়ে যেতে পারে।
- সুতরাং ভালো মানের যে মোজা-জোড়া আপনি ট্রেক করার সময় পরবেন বলে ঠিক করেছেন, সেটি পায়ে দিয়েই বুট ট্রাই করুন। এমন কোনও মেটেরিয়ালের মোজা বাছুন যা ঘাম শুষে নেবে এবং ওয়াটারপ্রুফ।
পায়ের জোর বাড়ান জিম-ওয়ার্কআউট করে
- সফল ট্রেকিং-এর চাবিকাঠি হল পায়ের জোর। এর জন্য হাঁটার প্রশিক্ষণ নেওয়ার পাশাপাশি পা-কে শক্তিশালী করে তোলার জন্য জিম এক্সারসাইজ করা শুরু করুন। লেগ প্রেস, ওয়েটেড স্কোয়াট, বডি ওয়েট স্কোয়াট প্রভৃতি জিম ওয়ার্ক প্র্যাকটিস করুন অভিজ্ঞ ট্রেনারের পরামর্শ অনুযায়ী।
ওয়াকিং ট্রেনিং বিল্ড করুন
- ট্রেকিং-এর মূল ভিত্তিই হল হাঁটার প্রশিক্ষণ। স্টেডিলি এমন দূরত্ব পর্যন্ত হাঁটার অভ্যাস করতে হবে যে দূরত্ব ট্রেকিং-এর সময়ও আপনাকে অতিক্রম করতে হবে। প্রাথমিকভাবে ট্রেনিং-এর দিনগুলোর মাঝে দু-একটা বিশ্রামের দিন রাখতে পারেন, তবে যত ট্রেনিং এগোবে এবং আপনার ফিটনেস বাড়বে ততই ব্যাক টু ব্যাক ট্রেনিং-এর দিন রাখুন। যা আপনার সত্যিকারের ট্রেক করার অভিজ্ঞতার কাছাকাছি হবে। এতে ট্রেকিং করার সময় আপনি থাকবেন ঝরঝরে এবং ফিট। আপনার ব্যস্ত শিডিউলের মধ্যেও এই ওয়াকিং ট্রেনিং-এর জন্য সময়টুকু বের করে নিন নিজের সুবিধে মতো। ভালো হয় প্রতিদিন কিছুটা সময় যদি পাহাড়ে হাঁটার জন্য নির্দিষ্ট জুতো এবং ভর্তি ব্যাকপ্যাক পিঠে বেঁধে হাঁটা প্র্যাকটিস করা যায়। এতে আপনার হাঁটাচলায় সত্যিই নজরে পড়ার মতো তফাৎ তৈরি হবে, যা ফাইনালি ট্রেকিং করার সময় আপনাকে বাড়তি সুবিধে দেবে।
ব্যাকপ্যাক সহ হাঁটার জন্য
- স্বাভাবিকভাবেই পাহাড়ে হাঁটার সময় আপনার ব্যাকপ্যাক নানা জিনিসপত্রে বোঝাই থাকবে। যেমন – খাবার, পানীয়, বাড়তি জামা-কাপড় এবং আরও নানা টুকিটাকি। সেক্ষেত্রে সঠিক ব্যাকপ্যাক নির্বাচন করা খুবই জরুরি। তাই ব্যাকপ্যাকের এমন মডেল পছন্দ করুন যার অ্যাডজাস্টেবল চেস্ট এবং ওয়েস্ট স্ট্র্যাপ আছে, যাতে আপনি আপনার পিঠে সেটিকে সঠিকভাবে স্থান দিতে পারেন। ব্যাকপ্যাকে এক্সটারনাল কমপ্রেশন স্ট্র্যাপ আছে কিনা সেটিও দেখে নিন। এতে পুরো ভার শিফট করবে না।
ট্রেকিং-এর সময় ফুয়েল অ্যাডিং
- হাইড্রেশনের মতোই ট্রেকিং চলাকালীন আপনার এনার্জি রিকোয়ারমেন্টসও বেড়ে যায়। তবে একগাদা খাবার কিন্তু খাবেন না। বারবার অল্প করে খান। এতে এনার্জি লেভেল সঠিক থাকবে। এই সময়ে যদি ফল খাওয়া যায় অল্প সময়ের ব্যবধানে তাহলে আপনি খুব ভালো এনার্জি পাবেন। ড্রাই ফ্রুটস, বিস্কুট, চকোলেট এসময় খুব কাজে আসবে।
ট্রেকিং করুন নিরাপদে
- ট্রেকিং করার পরিপূর্ণ আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন তখনই, যখন আপনার সহ অভিযাত্রীদের সঙ্গে প্রতিটি পাহাড়ি বাঁকের রোমাঞ্চ, পথের পাশে ফুটে থাকা নাম না জানা ফুলের সৌন্দর্য কিংবা তুষারশুভ্র পর্বত শৃঙ্গ দেখার মুগ্ধতা ভাগ করে নিতে পারবেন। তাই সব সময় গ্রুপ করে ট্রেকিং করতে যাওয়া ভালো। নিরাপত্তার দিক দিয়ে বিচার করলেও সব সময় গ্রুপে যাওয়াই উচিত। গ্রুপ মানেই পরস্পরকে সাহচর্য দেওয়াই নয় শুধু, পরস্পরকে সব বিষয়ে সহায়তা করাও। তবে যেখানেই ট্রেক করতে যান না কেন, আপনার বন্ধু বা পরিবারের অন্য সদস্যদের সমস্ত ইনফর্মেশন দিয়ে রাখুন। কোথায় যাচ্ছেন, কোন রুট ধরে হাঁটতে চলেছেন, মোটামুটি কতদিন পর ফিরতে পারেন সব বিস্তারিত জানিয়ে রাখুন তাদের। সঙ্গে রাখুন আইডেনটিটি কার্ড।
ট্রেক চলাকালীন বিভিন্ন বিপদ সম্পর্কে সতর্ক থাকুন
- কোনও সন্দেহজনক দেখতে ফুল বা অচেনা গাছপালায় (যা বিষাক্ত হতে পারে) হাত দেবেন না। যত সুন্দরই হোক দূর থেকে দেখেই সৌন্দর্য উপভোগ করুন।
- জোরালো গন্ধযুক্ত স্কিন বা হেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার করবেন না, যা কোনও বন্যপ্রানীর তিব্র ঘ্রাণশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারে।
- গাছপালার বেরিয়ে থাকা ডালপালা অথবা পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচতে পুরো দৈর্ঘের পোশাক পরুন।
- ঝর্ণা বা পথের পাশে জলাশয় দেখলেই সেই জল পান করার চেষ্টা করবেন না।
পজিটিভ থাকুন, স্টেডিলি হাঁটুন
- মনকে সঠিক ফ্রেমে ধরে রাখাটা ততটা জরুরি যতটা জরুরি ফিজিক্যাল ফিটনেস। মনকে তৈরি করে নিন আগে থাকতে। হাই অলটিটিউডে যাওয়া মানে সেটা কিন্তু এমন জায়গা নয় যেখানে আপনি পরিপূর্ণ আবেগে ভেসে যাবেন। সুতরাং যদি কোনও হতাশাব্যঞ্জক মুহূর্ত বা পরিস্থির সম্মুখীন হন, তাহলেও নিজেকে শান্ত রাখুন। আপনার সফর পরিকল্পনায় যথেষ্ট স্পেস রাখুন যাতে আপনার পরিকল্পনা ভুল পথে পরিচালিত হলেও আপনি বিভ্রান্ত বোধ না করেন। ‘ছোট স্টেপ, দীর্ঘ শ্বাস’-এটিই হোক আপনার ট্রেকিং-এর মন্ত্র। বিশেষ করে আপনি যখনই চড়াই পথে হাঁটছেন।
সানস্ক্রিন
- যে পথে আপনি ট্রেক করবেন সেই পথ যদি জঙ্গলাকীর্ণ না হয় তাহলে কিন্তু সূর্যরশ্মি আপনার ত্বকে এসে পড়বে। হাই আলটিটিউডে আলট্রা ভায়োলেট-রে অনেক তীব্রভাবে এসে পড়ে ত্বকে। এতে ত্বকে ট্যান যেমন পড়ে, তেমনই ত্বক নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থও হতে পারে। উচ্চ এসপিএফ যুক্ত সানস্ক্রিন লোশন সঙ্গে রাখুন এবং হাঁটা শুরু করার আগে দেহের যাবতীয় উন্মুক্ত অংশে লাগিয়ে নিন। হিল টপে আপনি যদি স্টে করার পর প্ল্যান করেন তাহলে সারাদিন সানস্ক্রিন লাগিয়ে রাখুন।
ওয়াকিং পোলস ব্যবহার
- ট্রেকিং করার সময় ওয়াকিং পোলস ব্যবহার করলে আপনার হাঁটার ছন্দ এবং গতিতে বাড়তি স্ট্রেন্থ যুক্ত হবে। ওয়াকিং পোলস হল পাহাড়ি পথে হাঁটার জন্য বিশেষভাবে তৈরি ছড়ি। এটি খুবই হালকা হলেও আপনার হাঁটু এবং থাই-এর লোড অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে চড়াই পথে হাঁটার সময়। এমনকি ধাপে ধাপে ওপরে হাঁটার সময় এই পোল ব্যবহার করা মানে বাড়তি পা যোগ হওয়া। ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে পথ হাঁটতেও কাজে আসতে পারে এই ছড়ি।
হাঁটার সময় ঘন ঘন নিজেকে হাইড্রেট করা
- ট্রেকিং করার সময় শরীরে ফ্লুইডের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। জোরে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া অথবা ঘাম ঝরার ফলে ব্লাড ভলিউম কমতে থাকে, যার ফলে হার্টের কার্যক্ষমতা বেশি কঠিন হয়ে যায়। আপনি যখনই তৃষ্ণার্ত বোধ করবেন হাঁটার সময়, মনে রাখবেন আপনি কিন্তু ইতিমধ্যেই ডিহাইড্রেটেড হয়ে পড়েছেন। এই সময় অল্প করে জল খেতে চেষ্টা করুন। সারাদিন ধরে বারবার জল খাবেন ট্রেকিং করার সময়। ইউরিনেশনের সময় ইউরিন কালার চেক করুন। যদি খড়ধোয়া জলের মতো হয়, তাহলে সেটি ঠিক আছে। আর তার চাইতে ঘন কোনও রঙ হওয়া মানেই আপনার আরও জলপানের প্রয়োজন আছে। যথেষ্ট পরিমাণ জল আপনাকে ক্যারি করতে হবে। কারণ পথে জল রিফিলিং করার সুযোগ পাবেন না।
অন্যান্য প্রয়োজনীয়
- পকেট নাইফ।
- এক্সট্রা ব্যাটারি সহ ফ্ল্যাশলাইট।
- এক্সট্রা ওয়াটার প্রুফ ম্যাচেস অথবা লাইটার।
- বায়োডিগ্রেডেবল টয়লেট পেপার।
ফার্স্ট এইড কিট
- অ্যাডেসিভ ব্যান্ডেজ, গজ, টেপ, সিজার, অ্যান্টিবায়োটিক অয়েনমেন্ট, অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরিস এবং পেইন রিলিজিং স্প্রে অথবা অয়েনমেন্ট রাখুন ফার্স্ট এইড বক্সে। পোকামাকড়ের কামড় বা হুল ফোটানর সমস্যা দূর করতে অ্যান্টিহিস্টামিন সঙ্গে রাখুন।
ছবিঃ দিপাঞ্জন মুন্সী