গল্পগুচ্ছ।।গ্রুম করার গল্প।।রূপক সাহা

অফিসে ঢোকার মুখে মেজাজটা বিগড়ে গেল সায়নের। লাভলি বিউটি পার্লারের বিজ্ঞাপনটা এমনভাবে দাঁড় করানো আছে যে, ওর অফিসের সাইনবোর্ডটাই দেখা যাচ্ছে না। বিউটি পার্লারের ম্যানেজার লাল্টুকে বেশ কয়েকবার বলা হয়েছে, স্ট্যান্ডিটা যেন আর একটু সরিয়ে দাঁড় করায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা? ছেলেটা বেয়াদপ টাইপের। ডেকে কিছু বলতে গেলেই মালিকনকে দেখিয়ে দেয়। বলে, ‘আপনি ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলুন, বস। আমার সঙ্গে কথা বলে কোনও লাভ হবে না।’ কথাটা এমনভাবে বলে যেন, অপরের জায়গা দখল করতে মালকিন ওকে শিখিয়ে দিয়েছেন!

বিউটি পার্লারের মালকিন লাভলি মিত্র। মেয়েটা ওরই বয়সি। সুন্দরী, সব সময় সেজেগুজে থাকে বলে আগুনের মতো জ্বলজ্বল করে। সায়ন শুনেছে, লাভলি নাকি আমেরিকা থেকে বিউটিশিয়ান কোর্স করে এসেছে। পার্লার ওপেন করার আগে, যেদিন ওর সঙ্গে প্রথম দেখা করতে এসেছিল, সেদিনই সায়ন বুঝতে পেরেছিল, মেয়েটার সঙ্গে ওর বনিবনা হবে না। কথায় কথায় লাভলি সেদিনই বলে দিয়েছিল,’আপনার এ দিকটা একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবেন। আমাকে বিউটি পার্লার চালাতে হবে। বুঝতেই পারছেন, এ-সব বিজনেসে আগে দেখনদারি। কথাটা কিন্তু মাথায় রাখবেন।’

শেষের কথাটা সায়নের হুমকির মতো লেগেছিল। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে এই মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিংয়ের একতলায় গোটা দশেক দোকান আর অফিস ঘর আছে। সায়নের অফিসটা সব থেকে ভাল পজিশনে। বিল্ডিং তৈরি হওয়ার সময় ভালো টাকা দিতে হয়েছিল দালালকে। তখনও অবশ্য ডিটেকটিভ এজেন্সি খোলার কথা ওর মাথায় আসেনি। ওর বড় মামা বিনয় ঘোষ ছিলেন লালবাজারের নামকরা গোয়েন্দা। তাঁকে দেখেই ছোটবেলা থেকে সায়নের গোয়েন্দা হওয়ার ইচ্ছে।

কিন্তু শুধু ইচ্ছে থাকলেই তো হয় না। সফল হওয়ার জন্য কপালেরও খানিকটা সাহায্য দরকার। এক বছর ধরে যার অভাব সায়ন লক্ষ্য করছে। এই বারো মাসে মোটা দশটা কেস ওর কাছে এসেছে। সব ক’টাই খুব ইন্টারেস্টিং। সংখ্যার দিক থেকেও এতগুলো কেস পাওয়া কম ভাগ্যের কথা নয়। কিন্তু মুশকিল হল, এতদিনে একটা কেসও সায়ন সলভ করতে পারেনি। যে-সব ক্লায়েন্ট প্রথম দিকে খাতির করে কথা বলতেন, কেস-এর প্রোগ্রেস নিয়ে জানার জন্য আসা-যাওয়া করতেন, তাঁরা অনেক সময় এখন মেজাজ দেখাচ্ছেন।

এমনিতেই ক্লায়েন্ট নিয়ে সায়ন ভীষণ ঝামেলার মধ্যে রয়েছে। তার ওপর ইদানীং শুরু হয়েছে পার্লারের উৎপাত। দিন কে দিন একটু একটু করে জায়গা দখল। কিছু বলতে গেলেই কথা কাটাকাটা শুরু করে দেয় লাভলি আর ওরা ধরেই নিয়েছে, সায়ন খুব দুর্বল প্রকৃতির মানুষ।

অন্য দিন হলে, সায়ন মুখ বুজে নিজের অফিসে ঢুকে যেত। কিন্তু আজ একটু পরেই ওর কাছে এক ক্লায়েন্ট আসার কথা। এমনিতেই ও টেনশনে আছে। অফিসে ঢোকার আগে বিজ্ঞাপনের স্ট্যান্ডিটা হাতে করে ও খানিকটা দূরে রেখে এল। বিজ্ঞাপনের কী ( বিউটি পার্লারের বাইরে এসে লাভলির চোখে পড়ল, বিজ্ঞাপনের স্ট্যান্ডিটা মেঝেয় লুটোচ্ছে। দেখেই ওর মাথা গরম হয়ে গেল। প্রচুর টাকা খরচা করে ও এই সব স্ট্যান্ডি বানিয়েছে। সায়ন বসুর এত বড় সাহস! সেই স্ট্যান্ডি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে! নাহ, লোকটাকে আজ ভালরকম শিক্ষা দিতে হবে।) ভাষা। ‘জগতে বিশ্রী দেখতে বলে কেউ নেই। আপনি যেমনই দেখতে হোন না কেন, লাভলি বিউটি পার্লারে একবার পা দিন। বেরিয়ে আসবেন প্থিবীর সেরা সুন্দরী হয়ে।’ স্ট্যান্ডিতে এই বিজ্ঞাপনে টিভি সিরিয়ালের এক নায়িকার ছবি। হাসি হাসি তাঁর মুখ। শ্যাম্পু করা চুল উড়ছে। অফিসে ঢোকা আর বেরনোর মাঝে রোজ সায়ন এই বিজ্ঞাপনটা দেখে। তখনই ওর ভ্রু কুঁচকে যায়। বিউটি পার্লার কি সত্যিই মানুষকে সুন্দর করে দিতে পারে? কে জানে, হয়ত পারে। না হলে লাভলির বিউটি পার্লারে সারাদিন এত ভিড় হয় কেন?

পার্লারের স্ট্যান্ডিটা সরিয়ে দিয়ে সায়ন খানিকটা স্বস্তি পেল। ও জানে, চোখে পড়ার পরই লাল্টু বলে ছেলেটা দৌড়তে দৌড়তে আসবে। ওর অফিসের রিসেপশনের সামনে এসে অসভ্যের মতো চেঁচাবে। চ্যাঁচাকে, সায়নেও আজ ছেড়ে দেবে না। কিছুদিন ধরেই ওর মন বলছে, একটা প্রতিবাদ করা দরকার। আশেপাশের দোকানের কেউ কেউ ওকে উৎসাহ দিয়েছে, ‘ছাড়বেন না’। কেউ আবার ভয় দেখিয়েছে, ‘না মশাই, লাভলির সঙ্গে পাঙ্গা নিতে যাবেন না। ওর সঙ্গে অনেক বড় বড় লোকের যোগাযোগ আছে। দোকানে বসে দেখি তো, কারা যাওয়া আসা করে। কাউন্সিলার থেকে মিনিস্টার-সব বাড়ির বউদের সঙ্গে লাভলির জানাশোনা। হরবখত লাল আলো জ্বালানো গাড়ি এসে দাঁড়ায় পার্লারের সামনে। যা করবেন, একটু ভেবে চিন্তে। না হলে কিন্তু প্রেস্টিজ নিয়ে টানাটানি হবে।’

অনেকদিন ধরে সায়ন এই সব সাবধানবাণী শুনে আসছে। আর সহ্য করবে না। লালবাজারে ওরও কি চেনাজানা নেই? আছে। বড় মামার আন্ডারে যে-সব অফিসার কাজ করতেন, তাঁরা এখন সব বড় বড় পোস্টে। একবার নিজে গিয়ে দাঁড়ালে নিশ্চয় তাঁরা চিনবেন। এত ভয় পাওয়ার কী আছে? ও তো কোনও অন্যায় করেনি। আইনও ভাঙেনি। তবে? অফিসে ঢুকে রিসেপশনে পৌঁছে সায়নের মনে হল, লাল্টুর ব্যাপারে হৈমবতীকে সাবধান করে দেওয়া দরকার। দাঁড়িয়ে পড়ে ও বলল, ‘হৈম শোনা, একটা কথা আছে।’

ওর ডিটেকটিভ এজেন্সিতে এই একজনই এমপ্লায়ি। হৈমবতী চাকলাদার। গোয়েন্দাগিরিতে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে রোজ অফিস খোলা থেকে কোম্পানির হিসেব-নিকেশ— সব সামলায়। রিসেপশনিস্টের কাজটাও করে দেয়। খুব সিরিয়াস টাইপের মেয়ে। চশমা পরে বলে ওকে আরও গম্ভীর দেখায়। হৈমবতী অবশ্য তখন খোলসা করে বলেছিল, কেন ও গোয়েন্দার সহকারী হতে আগ্রহী। ওর বাবা নামকরা গোয়েন্দা গল্প লেখক ছিলেন। এই তথ্যটা জেনে হৈমবতীকে সায়নের খুব পছন্দ হয়েছিল। ওর দ্ঢ় বিশ্বাস, পেশার হতে পারে না। মেয়েটা গোগ্রাসে গোয়েন্দা গল্প পড়ে। আজও কোনও বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রেখিছিল। সায়নের গলা শুনে বলল, ‘কী কথা স্যার?’

‘আর একটু পরেই পিঙ্কি আইচের আসার কথা। কী করা যায় বলো তো?’ চশমাটা নাকের কাছে এগিয়ে এসেছে। সেটা যথাস্থানে ঠেলে দিয়ে হৈমবতী বলল, ‘আসবেন কী, উনি এসে গেছেন স্যার। আপনার ঘরে জোর করে ঢুকে গেছেন। খুব রেগে আছেন বলে মনে হল।’ পিঙ্কি আইচ হলেন ওর ক্লায়েন্ট। শুনে একটু দমে গেল সায়ন। বলল, ‘রাগারই কথা। ঠিক আছে, ওকে আমি সামলে নিচ্ছি। এদিকে পার্লারের লাল্টু বলে ছেলেটা এসে হুজ্জোতে করতে পারে। ওকে পাত্তা দিতে স্যার। আসুক না একবার, দেখাব মজা।’

     ২

বিউটি পার্লারের বাইরে এসে লাভলির চোখে পড়ল, বিজ্ঞাপনের স্ট্যান্ডিটা মেঝেয় লুটোচ্ছে। দেখেই ওর মাথা গরম হয়ে গেল। প্রচুর টাকা খরচা করে ও এই সব স্ট্যান্ডি বানিয়েছে। সায়ন বসুর এত বড় সাহস! সেই স্ট্যান্ডি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে! নাহ, লোকটাকে আজ ভালরকম শিক্ষা দিতে হবে। ডিটেকটিভ এজেন্সির দিকে ও পা বাড়াল। আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। পরক্ষণেই ওর মনে হল, লোকটাকে ধমক দিয়ে কী লাভ? কিছু বলতে গেলে, ফ্যালফ্যাল করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। রুমাল দিয়ে ঘনঘন মুখ মুছতে থাকে। উত্তর দেওয়ার সময় ফাম্বল করে। একদিন তো লাভলি পার্মিশন না নিয়েই ওর অফিস ঘরে ঢুকে পড়েছিল। ওকে দেখে সায়ন বসু উঠে দাঁড়িয়েছিল। সেই দ্শ্যটা মনে পড়লে এখনও হাসি পায় লাভলির।

সায়ন বসুর ঘরে তখন এক ভদ্রলোক বসে। দু’একটা কথা শুনেই লাভলি বুঝে গিয়েছিল, কোনও ক্লায়েন্ট। সেই ভদ্রলোকও খুব তড়পাচ্ছিলেন সেই সময়। কোনও কেস নিয়ে এসেছিলেন বোধহয়। সায়ন বসু সলভ করতে পারেনি। ভদ্রলোকের শেষ কথাটা এখনও কানে বাজে লাভলির। ‘আপনাকে আর এক সপ্তাহ টাইম দিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে যদি কিছু করতে না পারেন, অ্যাডভান্সের টাকটা সেদিন ফেরত নিয়ে যাবে।’

সেদিনই লাভলি বুঝতে পেরে গিয়েছিল, সায়ন বসুর ডিটেকটিভ এজেন্সি কেমন চলে। লাল্টুও মাঝে মাঝে খবর এনে দেয়। ওর বেশি রাগ সায়ন বসুর অ্যাসিস্ট্যান্ট হৈমবতীর ওপর। মেয়েটা খুব অ্যাগ্রেসিভ টাইপের। লাল্টু বলে, ‘ সায়ন বসু লোকটা খারাপ না দিদি। যত নষ্টের গোড়া ওই মেয়েটা। পটর পটর করে ইংরেজি বলে। আমাকে পাত্তাই দেয় না। ওই মেয়েটাকে কিন্তু আমি ছাড়ব না।’

শপিং মলের অন্যরাও সায়ন সম্পর্কে খুব সিমপ্যাথেটিক। শপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি দিব্যজ্যোতি মল্লিকের কাছে লাভলি একদিন কমপ্লেন করতে গিয়েছিল। উনি ঠান্ডা গলায় বলেছিলেন, ‘সায়নকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি। ও আগ বাড়িয়ে কারও সঙ্গে ঝগড়া করতে যায় না। আপনার ম্যানেজার…কী যেন তার নাম…লাল্টু, হ্যাঁ, তাকে একটু সংযত হতে বলুন মিস মিত্র। আমি শুনেছি, সায়নের ক্লায়েন্টদের আপনার ছেলেটা ভড়কাচ্ছে।’ শুনে আর কথা বাড়ায়নি লাভলি। বুঝেই গিয়েছিল, ওর আগে দিব্যজ্যোতি মল্লিকের কাছে লাল্টুর নামে কমপ্লেন করা হয়ে গিয়েছে। কথাটা তো আর মিথ্যে নয়। লাল্টুর এই বদ স্বভাবটা আছে। কথায় কথায় ও একদিন বলেও ফেলেছিল, ‘ডিটেকটিভ এজেন্সিটাকে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি দিদি। ওই অফিসটা পেলে আমাদের পার্লার আরও বড় করা যাবে। মডেল গ্রুমিং সেন্টার খোলা যাবে।’ সেদিন লাভলি হ্যাঁ বলেনি, না-ও করেনি। রমরমিয়ে চলছে ওর পার্লার। আরও খানিকটা জায়গা পেলে মন্দ হয় না। সায়ন বসুর অফিসটা পেলে তো খুব ভাল হয়।

ডিটেকটিভ এজিন্সিতে পা দিতে যাবে। এমন সময় লাভলি শুনল, কে যেন পিছন থেকে ডাকছে, ‘লালি, এই লালি।’ এই নামে কে ওকে ডাকছে, দেখার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল লাভলি। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, মেঘনা। এই নামে ওই একজনই ওকে ডাকত। লাভলি দেখল, হন্ডা আই-ভি টেক গাড়ি থেকে নামছে মেঘনা। আজকাল এই গাড়ি চড়ছে নাকি ও! দাম কুড়ি-পঁচিশ লাখ তো হবেই। গাড়ির সাদা রংটার দিকে লাভলি তাকিয়ে রইল। ওর মনে হল, মেঘনা যেন একটা রাজহংসীর পিঠ থেকে নামল।

বেথুন কলেজে ওর বন্ধু ছিল মেঘনা। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। হাতিবাগান দিকে থাকত। কলেজে যাতায়াত করত ট্রামে-বাসে। মেঘনার সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছিল ওর বিয়েতে। সেও বছর দুয়েক আগে। তারপর লাভলি আমেরিকায় চলে যায়। ফিরে আসার পর পার্লার নিয়ে ও এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, মেঘনার কথা ওর মানেও পড়েনি। দূর থেকে ওকে দেখেই লাভলি বুঝতে পারল মেঘনার বর ওকে খুব সুখে রেখেছে।

কাছে এসে মেঘনা ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,’তুই এখানে? তোকে এখানে দেখব, আমি আশাই করিনি।’

‘আমিও তোকে এই প্রশ্নটা করব ভাবছিলাম।’ মেঘনা বলল, ‘বাব্বা, কী সুন্দর লাগছে রে তোকে লালি। জিম করছিস নাকি? লাভলি বলল, ‘তোকে দেখেও তো আমার সেই কথাটা মনে হচ্ছে।’

খিলখিল হাসিতে ভাঙে পড়ল মেঘনা। তার (‘সায়নকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি। ও আগ বাড়িয়ে কারও সঙ্গে ঝগড় করতে যায় না। আপনার ম্যানেজার…কী যেন তার নাম…লাল্টু , হ্যাঁ, তাকে একটু সংযত হতে বলুন মিস মিত্র। আমি শুনেছি, সায়নের ক্লায়েন্টদের আপনার ছেলেটা ভড়কাচ্ছে।’) পর বলল,’ মাঝে তোকে একদিন টিভিতে দেখলাম। বিউটি টিপস দিচ্ছিলি। খুব ভাল লাগছিল শুনতে। তখনই পল্লবকে ডেকে দেখলাম, দেখো, এ হচ্ছে লালি, আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড।’

‘আমার বর। সেদিন টিভিতে তোকে দেখে কী বলেছিল জানিস? না থাকে, তোকে বলব না। বললে তুই মাথায় চড়ে বসবি।’ কথাগুলো বলতে বলতেই মেঘনার চোখ গেল বিউটি পার্লারের দিকে। ‘আরে, এই পার্লারটা তুই খুলেছিস নাকি? এখন মনে পড়ছে, টিভিতে সেদিন তুই তা হলে তোর পার্লারের কথাই বলছিলি?’ চ্যানেল ফিফটিন-এ প্রতি সপ্তাহে একটা প্রোগ্রাম করে লাভলি। মেঘনা বোধহয় কোনও একটা এপিসোড দেখছে। টিভিতে অ্যাপিয়ার হওয়ার একটা সুবিধে। চট করে ক্লায়েন্টদের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়। লাভলি বলল, ‘আয়, পার্লারের ভেতরে আয়। তোকে একটু ঘুরিয়ে দেখাই। ইচ্ছে করলে আজ কিছু করিয়ে নিতে পারিস। আমার মেয়েগুলো খুব ভালো কাজ করে। চল, তোর সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিই।’

এক পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মেঘনা। তার পর বলল, ‘দাঁড়া, যে কাজের জন্য এসেছিলাম, আগে সেটা সেরে নিই। এই সায়ন বসুর অফিসটা কোথায় রে? নামকরা ডিটেকটিভ। তুই চিনিস?’

জোর একটা ঝটকা খেল লাভলি। সায়ন বসু মেঘনার রিলেটিভ! সে আবার কবে নামকরা ডিটেকটিভ হল! শুনে হাসি পেল ওর। সম্পর্ক যতই তিক্ত হোক না কেন, চেনে না বলাটা উচিত হবে না। লাভলি তাই বলল,হ্যাঁ জানি। এই তো সায়ন বসুর অফিস। ওর কাছে…কী মানে করে?’

‘টুটুলদা, মানে সায়ন বসু আমার পিসতুতো দাদা। খুব ভাল মানুষ রে। দাদা বলে বলছি না, আজকালকার যুগে এমন একটা ছেলে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। জানিস, শিবপুর থেকে এম টেক করেছে। আমেদাবাদ থেকে এম বি এ। পিসেমশাই চেয়েছিল, টুটুলদা বিজনেস কনসালটেন্ট হোক। কিন্তু দ্যাখ, কারও কথা শুনল না। গোয়েন্দাগিরি নিয়ে মেতে গেল। আমরাও বাধা দিইনি। টুটুলদার যা ভাল লাগে, করুক। পিসেমশাই ওর জন্য বিশাল সম্পত্তি রেখে গিয়েছেন। নিজের ভাই-বোনও কেউ নেই। ইচ্ছে করলে টুটুলদা সারা জীবন বসে খেতে পারে।’

‘তোর দাদা বিয়ে থা করেননি?’

‘না। পিসিমা বিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও মেয়েকে টুটুলদার মনে ধরেনি। বছর দেড়েক আগে পিসিমা মারা গেছে। এখন তো, আমি আর পল্লব ছাড়া, ওকে বিয়ের কথা বলারও লোক নেই।শুধু আমিই ওর খোঁজ খবর নিই।’ বলে ঘড়ির দিকে তাকাল মেঘনা। ‘এই রে তিন মিনিট লেট হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ঝাড় খাব। যাই আগে টুটুলদার সঙ্গে দেখা করে আসি।’

‘ঝাড় খাবি মানে?’

(টুটুলদা, মানে সায়ন বসু আমার পিসতুতো দাদা। খুব ভাল মানুষ রে। দাদা বলে বলছি না, আজকালকার যুগে এমন একটা ছেলে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। জানিস, শিবপুর থেকে এম টেক করেছে। আমেদাবাদা থেকে এম বি এ। পিসেমশাই চেয়েছিল, টুটুলদা বিজনেস কনসালটেন্ট হোক। কিন্তু দ্যাখ, কারও কথা শুনল না। গোয়েন্দাগিরি নিয়ে মেতে গেল।)

‘তুই জানিস না ভাই, টুটুলদা কী রকম পাংচুয়াল। আমায় ঠিক বারোটার সময় টাইম দিয়েছিল। এখন বারোটা বেজে তিন। পার্লারে ঢুকছি। কোথাও বেরিয়ে যাস না যেন। আমার মেয়ের অন্নপ্রাশন আগামী রবিবার। ভালই হল তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এখানেই নেমন্তন্নটা সেরে নেব।’

কথাগুলো বলে হনহন করে মেঘনা ডিটেকটিভ এজেন্সিতে ঢুকে গেল।

                                                                                                ৩

নিজের চেম্বারের দিকে পা বাড়াল সায়ন। পিঙ্কি আইচ ওর গোয়েন্দা জীবনের প্রথম ক্লায়েন্ট। থাকেন গলফ ক্লাবের দিকে। ভদ্রমহিলার স্বামী ভূতনাথ আইচ বর্ধমানের কয়েকটা কোল্ড স্টোরেজের মালিক। প্রচুর পয়সা। পিঙ্কি আইচের মুখে সায়ন বেশ কয়েকবারই শুনেছে, এককালে ওঁর স্বামী নাকে বক্সিংয়ে বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। প্রথম দিন ঘরে ঢুকেই একতাড়া নোট টেবিলের ওপর ফেলে দিয়ে পিঙ্কি বলেছিলেন,’এই নিন ভাই, আমার কেসটা সলভ করে দিন। তেমন হলে আরও দশ হাজার টাকা খুশি হয়ে দিয়ে যাব। বাট মাইন্ড ইট, খুব তাড়াতাড়ি সলভ হওয়া দরকার।’

কেসটা কী, তা শোনার আগেই টাকা! সায়ন অভিভূত হয়ে গিয়েছিল সেদিন। মন দিয়ে পিঙ্কি আইচের অভিযোগটা শুনেছিল। স্বামীর প্রতি সন্দেহ। পনেরো বিবাহিত জীবন কাটানোর পরও ওঁরা নিঃসন্তান। ইদানীং পিঙ্কির ধারণা হয়েছে, ভূতনাথ অন্য মহিলায় আসক্ত। বছর খানেক ধরে দু’জনের মধ্যে নাকি শারীরিক সম্পর্কও নেই। কোল্ড স্টোরেজ ব্যবসার কারণে ভদ্রলোককে মাঝে মাঝে বর্ধমানে গিয়ে থাকতে হয়। পিঙ্কি জানতে পেরেছেন, বর্ধমানে যাওয়ার নাম করে বেরোন বটে, কিন্তু সেখানে ভূতনাথবাবু যান না। প্রায়ই নাইট ক্লাবে যান। আকন্ঠ মদ্যপান করে ফেরেন।কোথায় যান, জিজ্ঞেস করলেও তার জবাব দেন না। এ ব্যাপারেই সায়নের খোঁজ খবর করার কথা।

ভূতনাথবাবুর সঙ্গে কারও অবৈধ সম্পর্ক আছে কি না, তা জেনে দিতে হবে। শুধু খবরটা এনে দিলেই চলবে না। সেই সঙ্গে প্রমাণও হাজির করতে হবে। যাতে পিঙ্কি আইচ ডিভোর্স চাইতে পারেন। গত এক বছরে এই কেসটা সলভ করতে পারেনি সায়ন। অনেক দিন ভুতনাথবাবুকে ফলো করা সত্ত্বেও। ভদ্রলোক ইন্টারন্যাশনাল ক্লাবের মেম্বার। সায়নও। কে একজন আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। সুযোগ পেয়ে একদিন ভদ্রলোকের সঙ্গে সায়ন মদ্যপান করতেও বসেছিল। পেট থেকে কথা বের করার জন্য। ভুতনাথবাবু সেদিন বলেই ফেলেছিলেন, ‘আমার বউটা এমন গাঁইয়া, ক্লাবে নিয়ে আসার যোগ্য না মশাই। আপনাকে একটা অ্যাডভাইস করি ভাই। এমন মেয়েকে বিয়ে করবেন, যে সত্যি সত্যি আপনার লাইফ পার্টনার হতে পারে। টাকার লোভে জোতদারের মেয়েকে বিয়ে করে আমার জীবনটা হাল্লাক হয়ে গেল’। সেদিনই সায়নের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল’। সেদিনই সায়নের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, ‘দুজনের দাম্পত্য সম্পর্কটা খারাপ হয়েছে লাইফ স্টাইলের পার্থক্যে। পিঙ্কি আইচ সত্যিই আটপৌরে  টাইপের। কতই বা বয়স হবে? চল্লিশের কাছাকাছি। এর মধ্যেই মুটিয়ে গিয়েছেন। সাজগোজের কোনও বালাই নেই। কথাবার্তাতেও কেমন যেন।

মনেরমতো খবরটা না পেয়ে পিঙ্কি আইচ অধৈর্য হয়ে গিয়েছেন। আজ আসার কথা ফয়সালা করার জন্য। মাসখানেক আগে শেষবার যখন উনি আসেন, তখন হুমকি দিয়ে গিয়েছিলেন,’কিসের গোয়েন্দা আপনি মশাই? সামান্য একটা কেস সলভ করতে পারেন না? পরের বার এসে যেন কংক্রিট খবর পাই। না হলে গলায় গামছা দিয়ে আমার অ্যাডভান্সের টাকা আদায় করে নেব।’ সেদিন খুব খারাপ লেগেছিল সায়নের কথাটা শুনে। পিঙ্কি আইচের কথাবার্তায় ইদানীং জোতদারের মেয়েই বেরিয়ে আসছে। কেসটা নিয়ে ও অনেক ভেবেছে। কিন্তু কীভাবে সমাধান করবে, তা বুঝতে পারছে না।

ঘরে ঢোকার আগেই সায়ন একবার ভাবল, বেশি জোরাজুরি করলে পিঙ্কির অ্যাডভান্সের টাকা ফেরত দিয়ে দেবে। এমন মহিলার কাজ ও আর করবে না। বেগড়বাঁই করলে পিঙ্কিকে ও পাঁচকথা শুনিয়ে দেবে। কিন্তু পরক্ষণেই ওর মনে পড়ল হৈমবতীর কথা। ‘স্যার, আমাদের প্রোফেশনটা হচ্ছে উকিলদের মতো। চট করে ক্লায়েন্ট হাতছাড়া করা উচিত হবে না। গোয়েন্দাগিরিও এখন একধরণের ব্যবসা। আপনাকে মিথ্যে কথা বলতে বলছি না স্যার। কিন্তু কথাবার্তায় একটু প্রোফেশনাল হলে ক্ষতি কী?’

হৈমবতীর কথামতো আজ প্রোফেশাল হবে সায়ন। মনস্থির করে ঘরে ঢুকে ও নিজের চেয়ারে বসল। প্রথমেই যে প্রশ্নটা ও আশা করেছিল, সেটাই করলেন পিঙ্কি আইচ, ‘কী ভাই, আমার কেসটার কিছু হল?’

সায়ন বলল, ‘প্রায় সলভ করে এনেছি মিসেস আইচ।’

মুহুর্তে বদলে গেল পিঙ্কির মুখ। চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, ‘মেয়েছেলেটা কে, বলুন তো। নাম ভূতনাথবাবুর ম্যাক্সিমাম কল আসে পার্টিকুলার নাম্বার থেকে। সেখানে ফোন করলেই এক মহিলা এসে ধরেন। ল্যান্ড লাইনের নাম্বার।’

‘ওই নাম্বারটা আমার দিতে পারেন?

‘দিচ্ছি। তবে তার আগে আমাকে বলুন, বোড়ালের দিকে কি আপনাদের পরিচিত কেউ থাকেন? মানে কোনও রিলেটিভ বা ফ্যামিলি ফ্রেন্ড?’

‘বোড়াল? না ভাই আমি চিনি না। আমি বর্ধমানের মেয়ে। আমি বোড়াল চিনব কী করে?’

‘বোড়ালের নামই শোনেননি? সত্যজিৎ রায় যেখানে পথের পাঁচালী সিনেমার শুটিং করেছিলেন, ছবিটা দেখেননি?’

‘ছোটবেলায় দেখেছি হয়ত। অত মনে নেই। শয়তানি মেয়েছেলেটা সেখানে থাকে নাকি?’

‘সেটা পরে বলছি। বোড়াল জায়গাটা হল গড়িয়ার কাছে। আপনার স্বামী ইদানিং মাসে একবার করে সেখানে যান। আমিও দু’একদিন ফলো করে গিয়েছি। কিন্তু যে বাড়িতে উনি যান, সেটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। স্থানীয় মানুষদের কাছে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, সেখানে প্রচুর মহিলা ও পুরুষ যাতায়াত করেন।’

‘ বুঝেছি, মধুচক্র হবে নিশ্চয়। কিন্তু আপনি যে বলতেন ও ইন্টারন্যাশনাল ক্লাবে যেত? এখন যায় না?’

‘হ্যাঁ, সেখানেও যান। তবে একটু আধটু ড্রিঙ্ক করার জন্য।’

‘ড্রিঙ্ক করুক। আমার আপত্তি নেই। ছোটবেলা থেকেই বাপ-ঠাকুর্দাকে মাল খেতে দেখছি। আমার কথা হল ঘরে বউ আছে। বাইরে গিয়ে ছুঁকছুঁক করবে কেন? যাক সে-সব কথা। বোড়াল, না কোথায়। আপনি কি আমায় সেখানে নিয়ে যেতে পারেন?

‘অফকোর্স নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু তাতে আপনার কোনও লাভ হবে না।’

‘কেন লাভ হবে না?’ বলতে বলতে ভ্রূ কুঁচকে যায় পিঙ্কি আইচের।

‘ওখানে গিয়ে আপনি ঝামেলা করতে পারেন। কিন্তু আপনি যে ধরণের প্রমান চান, তা কিন্তু পাবেন না।’

‘আপনিই বা প্রমাণ দিতে পারছেন কোথায়?’ গলা চড়ালেন পিঙ্কি। ‘এক বছর তা হয়ে গেল। ইস, কী যে ভুল করেছি আমি কেসটা আপনার হাতে দিয়ে। এর থেকে গ্লোব ডিটেকটিভ এজেন্সির কাছে গেলে ভাল করতাম। যাক গে, আক্ষেপ করে কোনও লাভ নেই। ভূতনাথ কার সঙ্গে প্রেম করছে, আমায় সেটা বলুন।’

‘সরি মিসেস আইচ, ইনভেস্টিগেশনের এই স্টেজে সেই নামটা আপনাকে বলতে পারব না।’

পিঙ্কি আইচ চিৎকার করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দরজার ল্যাচ ঘোরানোর শব্দ। পিঙ্কি তাই চুপ করে গেলেন। দরজার দিকে তাকিয়ে সায়ন দেখল, বিউটি পার্লারের লাভলি মিত্র এসে দাঁড়িয়েছে। সেটা লক্ষ্য করা মাত্র পিঙ্ক আইচের কেসটা প্রায় সলভ করে ফেলল সায়ন। আইচদের কেসটা প্রায় সলভ করে ফেলল সায়ন। আইচদের দাম্পত্য সুখ ও ফিরিয়ে আনতে পারবে। তবে এ ব্যাপারে ওর দরকার লাভলি মিত্রের সাহায্যে।

                                                                                       ৪

ডায়মন্ড সিটি কমপ্লেক্সে এসেছে লাভলি। মেঘনার মেয়ের অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন রক্ষা করতে। বিশাল কমপ্লেক্স। বড় বড় বেশ কয়েকটা টাওয়ার। মেঝেমাঝে অনেকটা খোলা জায়গা। বাহারি সব গাছ। রাতে আলো-আঁধারিতে কমপ্লেক্সটা দেখে লাভলির বেশ ভাল লেগে গেল। তিন নম্বর টাওয়ারের ইলেভেন্থ ফ্লোরে মেঘনাদের ফ্ল্যাট। লিফটে করে উঠে এসে লাভলি দেখে, পল্লব আর মেঘনা করিডোর দিয়ে হেঁটে আসছে। ওকে দেখে মেঘনা খুশিতে উচ্ছল হয়ে বলল,’তুই এসেছিস! আমি তো ভাবলাম, আসবি না। যা ঘরে গিয়ে বোস। আমার নতুন ফ্ল্যাটটা ঘুরে ঘুরে দ্যাখ।

নিচের কমিউনিটি হল থেকে আমি চট করে ঘুরে আসছি। দেব এসেছে। ওকে নিয়েই আমি উঠে আসব।’

লাভলি জিজ্ঞেস করল,’কোন দেবের কথা বলছিস?’

‘ফিল্ম অ্যাক্টর দেব। ও তো পল্লবের বন্ধু। মুম্বইয়ে ওরা একই কমপ্লেক্সে থাকত। তোর সঙ্গে দেবের আজ আলাপ করিয়ে দেব। একদিন তোর পার্লারে নিয়ে যাস। দেখবি, ওর কত ক্রেজ।’

সায়নের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে ভেবে, লাভলি এখানে আসতে ইতস্তত করছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এসে ভালই করেছে। দেবকে ওর পার্লারে নিয়ে যেতে পারলে, অল্প বয়সি ক্লায়েন্টদের চমকে দেওয়া যাবে। ওর পার্লারের নাম ফেটে যাবে। সেদিন খবরের কাগজের লোকদেরও ও ডেকে আনবে। যাতে পাবলিসিটি পাওয়া যায়। চট করে এসব ভেবে নিল লাভলি। মেঘনার মেয়ের জন্য অঞ্জনা।

জুয়েলার্স থেকে সোনার আংটি কিনে এনেছে। সেটা দেওয়ার জন্যই লাভলি জিজ্ঞেসা করল, তোর পুঁচকেটা এখন কোথায় রে?’

‘কমিউনিটি হলে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা সব ওখানে। গেস্টরা আসতে শুরু করেছে। আমার পুঁচকেটা তাই ওখানেই দিদার কোলে কোলে ঘুরছে। দাঁড়া ওকে নিয়ে আসছি।

বলেই লিফটে করে মেঘনারা নিচে নেমে গেল। খুশি মনে কয়েক পা হেঁটে ঘরের ভিতর ঢুকে লাভলি দেখল, লোকজন বিশেষ কেউ নেই। আমন্ত্রিতরা সবাই বোধহয় এখন কমিউনিটি হলে। সোফার এক কোণে বসে ও খুঁটিয়ে ফ্ল্যাটটা দেখতে লাগল। মেঘনা যেদিন ওর পার্লারে গিয়েছিল, সেদিনই কথায় কথায় বলেছিল, এই ফ্ল্যাটটা ওরা মাস দুয়েক আগে কিনেছে। খুব সুন্দর করে সাজিয়েওছে। দেওয়ালে নানা ধরণের হালকা রং। খুব ম্যাচ করেছে দুধের মতো সাদা সোফাগুলোও। আসবাব সব দেওয়ালের সঙ্গে ফিট করা। কাঁচের শো-কেসে দামি দামি শো-পিস। ফ্ল্যাটটা কম করে দু’হাজার স্কোয়্যার ফিটের তো হবেই। দাম সত্তর-পঁচাত্তর লাখ টাকার কম নয়। লোকালিটিও মন্দ না। টালিগঞ্জের মেট্রো স্টেশনের খুব কাছে। এরকম একটা কমপ্লেক্সে হাই সোসাইটির লোকজনও নিশ্চিয়ই বাস করেন প্রচুর। লাভলি ঠিক করে নিল, ডায়মন্ড সিটিতে ওর পার্লারের পাবলিসিটি করতে হবে। ওর পার্লারের পাবলিসিটি করতে হবে। ওর পার্লার খুব বেশি দূরেও নয়। এক কিলোমিটারের মধ্যে।

সোফা থেকে উঠে গিয়ে, ঘুরে ঘুরে লাভলি ফ্ল্যাটটা দেখতে লাগল। দুটো বড় বেডরুম, একটা গেস্টরুম আর ড্রয়িং রুম। দুটো বাথরুমও আছে। পূর্ব দিকে একটা বারান্দাও। সেখান থেকে সাউথ সিটি মলের টাওয়ারগুলো দেখা যাচ্ছে। দুটো টাওয়ারের মাঝে আধভাঙা চাঁদ। কী সুন্দর লাগছে দেখতে! ফুরফুরে বাতাস বইছে। বারান্দায় খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার সময় লাভলি একবার নিচের দিকে তাকাল। কমিউনিটি হলেও বাইরে বেশ ভিড়। সায়নও নিশ্চয় ওখানে আছে। সায়নের কথা মনে হতেই লাভলির বুকের ভিতরটা কেমন যেন শিরশির করে উঠল। মেঘনা সেই যে নেমে গিয়েছে, আর ফেরার নাম নেই। লাভলি ঠিক করে উঠতে পারল না, ও নিচে নেমে যাবে কী না।

ফিরে এসে সোফায় বসার সময় দেওয়ালে একটা ছবির দিকে তাকিয়ে ওর চোখ আটকে গেল। চেনা চেনা লাগছে। মেঘনা আর পল্লবের মাঝে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। আরে, এ তো সায়ন! সুট-টাই পরা। ছবিটা বোধহয় মেঘনার বউভাতের দিন তোলা। মেঘনার সাজ দেখে সেটাই মনে হচ্ছে। কী হ্যান্ডসামই না লাগছে সায়নকে দেখতে! ছবিটার দিকে তাকিয়ে লাভলির বুকের ভিতরটা দ্বিতীয়বার শিরশির করে উঠল। ছবির দিকে অপলক ও তাকিয়েই রইল । শপিং কমপ্লেক্সে ও অনেকবার সায়নের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু ছবিতে ওকে একেবারে অন্যরকম লাগছে। লাভলির মনে হল, এই মুহূর্তে দেব যদি এই ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ায়, কেউ ফিরেও তাকাবে না ওর দিকে।

‘হাঁ করে কী দেখছিস লালি?’ প্রশ্নটা শুনে চমকে তাকাল লাভলি। মেঘনা, ওর কোলে পুতুলের মতো ছোট্ট একটা সোনা। একদম মেঘনার মতো দেখতে। দেখেই হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিল লাভলি। সুন্দর বাচ্চা দেখলেই ওর চটকাতে ইচ্ছে করে। আদর করে বাচ্চাটাকে ফেরত দিয়েই লাভলি জিজ্ঞেস করল, ‘ কই, দেব এল না?’

মেঘনা বলল,’আসবে। আমাদের এই কমপ্লেক্সেই শুভশ্রী থাকে। ওর হিরোইন। শুভশ্রী ওকে টেনে নিয়ে গেল। তা তুই হাঁ করে কার ছবি দেখছিল রে? টুটুলদার?’ বলেই হি হি করে হাসতে শুরু করল মেঘনা।

ধরা পড়ে গিয়ে কথা ঘোরানোর চেষ্টার লাভলি বলল,’মোটেই না। বউভাতের দিন তোর মেক আপটা দেখছিলাম। কে করেছিল রে? খুব সুন্দর লাগছে তোকে দেখতে।’

‘আর বলিস না। সেদিন টুটুলদা জোর করে ধরে নিয়ে এসেছিল অনিরুদ্ধ চাকলাদারকে। টুটুলদার কথায় মনে পড়ল… এই দ্যাখ, তাকে বলতে ভুলে গেছি। টুটুলদা আজ আসতে পারল না রে। কেন জানিস? কাল ভোরের ফ্লাইটেই দুবাই চলে যাচ্ছে। হঠাৎ কী হয়েছে, কে জানে? দু’দিনের মধ্যেই একটা বিশাল চাকরি জোগাড় করে ফেলেছে ওখানে। আমি আর পল্লব কত করে বোঝালাম, শুনলই না।’ মন থেকে হঠাৎ খুশি খুশি ভাবটা উধাও হয়ে গেল লাভলির। কোনও রকম আগ্রহ দেখাবে না ঠিক করেও, লাভলি জিজ্ঞেস করে ফেলল,’তা হলে ডিটেকটিভ এজেন্সির কী হবে?’

‘দেনা-পাওনা মিটিয়ে দিয়ে আপতত বন্ধ করে দেবে। আসলে কী হয়েছে জানিস। হৈমবতী বলে যে মেয়েটা টুটুলদার অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল, সে হিসাব করে দেখিয়েছে, দেড় বছরে ডিটেকটিভ এজেন্সি চালিয়ে টুটুলদার লোকসান হয়েছে প্রায় দশ লাখ টাকার মতো। এই লস আর ও চোখে দেখতে পারছে না। সেই কারণে চাকরিটা ও ছেড়ে দিল। আরও ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, মেয়েটা বিয়ে করছে। এই একটু আগে আমাকে বলে গেল। কার সঙ্গে বিয়েটা হচ্ছে জানিস? শুনে চমকে উঠিস না যেন। তোর পার্লারের ম্যানেজার ললিতমোহন ওরফে লাল্টুর সঙ্গে। রোজ নাকি ঝগড়া হত দু’জনের মধ্যে। হঠাৎ প্রেম হয়ে গেছে।’

শুনে সত্যিই চমকে উঠল লাভলি। লাল্টু যে বিয়ে করছে, ও তা জানে না। লাল্টু ওকে বলেওনি। ওর অজান্তে এমন দুটো ঘটনা ঘটে গেল, অথচ ও কিছুই টের পেলে না, ভেবে মনটা দমে গেল লাভলির। বাচচোর আঙুলে উপহারের আংটি পরিয়ে দিয়ে ও বলল,’আজ আমি যাই রে। দু’একদিন পর ফের তোর এখানে আসব। তখন জময়ে আড্ডা মারা যাবে।’

                                                                                          ৫

লইয়ার তপেশবাবুকে ডেকে পাঠিয়েছিল সায়ন। কুবের শপিং কমপ্লেক্সি ওর অফিস প্রেমিসেস পাঁচ বছরের জন্য ভাড়া দিতে চায়। তপেশবাবুকে ও বলেছে, ফার্স্ট প্রেফারেন্স দেওয়া হবে বিউটি পার্লারের মালকিন লাভলি মিত্রকে। ও যদি ভাড়া নিতে চায়, তা হলে নিতে পারে। এই মর্মে একটা বয়ান লিখে আনতে বলেছিল সায়ন তপেশবাবুকে। ভদ্রলোক কোর্ট পেপার দিয়ে গিয়েছেন। তাতে চোখ বুলিয়ে নিশ্চিন্ত হল সায়ন। লাভলি মিত্রকে একবার ফোন করে জানিয়ে দেবে কী না, ও চিন্তা করতে লাগল। কাল সকালের ফার্স্ট ফ্লাইটে ও মুম্বাই যাবে। ওখান থেকে দুপুরের ফ্লাইটে দুবাই। আপাতত আর ফিরছি না কলকাতায়।

এক সপ্তাহ আগেও সায়ন জানত না, এরকম একটা ডিসিশোন নেবে। কিন্তু চার-পাঁচ দিন আগে এমন একটা গটনা ঘটে গেল, লজ্জায় ওর মাথা কাটা গিয়েছে। লাভলি মিত্রের সামনেই পিঙ্কি আইচ, ওকে যা নয় তাই বলে গিয়েছেন। ঠকবাজ, অকম্মার ঢেঁকি, ভুতনাথের কাছ থেকে পয়সা খেয়েছেন-আরও কত কী। লাভলি ধমক না দিলে ভদ্রমহিলা থামতেন না। বুঝিয়ে সুঝিয়ে ও-ই পিঙ্কি আইচকে ওর পার্লারে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিনই সন্ধে বেলায় লাভলি এসে জনতে চেয়েছিল কেসটা কী? কেন সায়ন কেসটা সলভ করতে পারছে না? ওর কাছ থেকে খুঁটিনাটি সব জেনে নিয়েছিল।

সব শুনে লাভলি বলেছিল,’আপনার কেসটা যদি আমি সলভ করে দিন, আপত্তি আছে?’

মুখ তুলে কথা বলার মতো অবস্থাও ছিল না। কোনও রকমে সায়ন বলেছিল, ‘ আপনি সলভ করবেন? কীভাবে?

লাভলি বলেছিল,’সেটা আমার উপরই ছেড়ে দিন না। সিম্পল কেস। ভুতনাথবাবু বউকে এমনভাবে পেতে চান, যাতে ওর সোসাইটিতে সস্ত্রীক চলাফেরা করতে পারেন। চাওয়াটা এমন কিছু বেশি না। আমাকে যেটা করতে হবে, সেটা হল পিঙ্কি আইচকে তৈরি করে দিতে হবে। অর্থাৎ কি না গ্রুম করতে হবে।কথা দিচ্ছি, মাস তিনেকের মধ্যে ভুতনাথ বাবুর আশা পূরণ করতে পারব। ঘষে মেজে এমন করে দেব, ভদ্রলোক বউকে নিয়ে প্রাউড ফিল করবেন।(‘লাভলি বলেছিল,’সেটা আমার উপরেই ছেড়ে দিন না। সিম্পল কেস। ভুতনাথ বাবু বউকে এমনভাবে পেতে চান, যাতে ওর সোসাইটিতে সস্ত্রীক চলাফেরা করতে পারেন। চাওয়া এমন কিছু বেশি না। আমাকে যেটা করতে হবে, সেটা হল পিঙ্কি আইচকে তৈরি করে দিতে হবে। অর্থাৎ কি না গ্রুম করতে হবে। কথা দিচ্ছি, মাস তিনেকের মধ্যে ভুতনাথবাবুর আশা পূরণ করতে পারব। ঘষে মেজে এমন করে দেব, ভদ্রলোক বউকে নিয়ে প্রাউড ফিল করবেন।’)সায়নের বিশ্বাস হয়নি। ও বলেছিল, আপনি পারবেন এ রকম একটা গাইয়া মহিলাকে কালচার্ড করতে?’

‘কেন নয়? পার্লারে নিয়ে গিয়ে আজই ছোটখাটো এক্সপেরিমেন্ট করেছি। সাজিয়ে গুছিয়ে এমন মেকওবার করেছি, ভদ্রমহিলা নিজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে চিনতে পারছিলেন না। খুব খুশি মনে উনি বেরিয়ে গেলেন। আমি সিওর, ওকে দেখে ভুতনাথবাবুও অবাক হয়ে যাবেন। ওঁদের দাম্পত্যজীবন টিকে যাবে। পিঙ্কি আইচ যাওয়ার সময় আমায় কী বলে গেলেন জানেন, মাথা গরম করে সায়নবাবুকে কটু কথা বলে ফেলেছি। এখন খুব খারাপ লাগছে।’

সায়ন বলেছিল,’থ্যাঙ্কস মিস মিত্র। কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব, জানি না।’ ‘থাক, অত ফর্মাল হতে হবে না। সামান্য সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট, মানুষ কত বদলে যায় ভাবুন তো। যাঁরা আমাদের কাছে আসেন, তাঁরা বেঁচে যান। আমাদের কাছে আসেন, তাঁরা বেঁচে যান। আমরা বিউটিশিয়ানরা তো এই কনসেপ্টটাই বেচি। নিজেকে সুন্দর করে রাখো, নিজেকে সুন্দর ভাবো। দেখবে সম্পর্কগুলো কেমন সুন্দর থাকবে। আপনাকে অবশ্য এই কনস্পেট বিক্রি করে লাভ নেই। কেন না, ভগবান আপনাতে খুব হ্যান্ডসাম করেই পাঠিয়েছেন।’ বলেই মিষ্টি করে হেসেছিল লাভলি।’

তারপরই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল,’দিন হাতটা দিন। আজ থেকে ঝগড়া নয়। আমরা ফ্রেন্ড।’

বাড়িয়ে দেওয়ার সময় হাতটা কাঁপছিল সায়নের। হঠাৎ লাভলি মিত্রের এই মিত্রের এই পরিবর্তন, ও ঠিক নিতে পারছিল না। কে জানে, এটা কূটকৌশল কী না? হয়তো করেক দিন পরই বলে বসতে পারে, গ্রুমিং সেন্টার খোলার জন্য আমার কিছু স্পেস দরকার। দিন না, আপনার অফিসটা। ডিটেকটিভ এজেন্সিটা তুলে দিলে কী এমন ক্ষতি হবে? লাভলি অবশ্য কথাটা বলেনি । উল্টে, একদিন ডিনার করার নেমন্তন্ন করেছিল আইভরি রেস্তোরাঁতে। সেদিন সায়ন যায়নি। খুব মোলায়েমভাবে রিফিউজ করেছিল। ওর মনটাও খারাপ ছিল সেদিন। কেননা হৈমবতী সেদিনই চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাছে কাগজপত্তর পাঠানোর আগে বলেছিল, ‘স্যার, আমার সাজেশন যদি নেন, তা হলে বলি, টাকা পয়সাগুলো এভাবে আর নষ্ট করবেন না।’ শুনে মনটা আরও দমে গিয়েছিল সায়নের। হৈমবতী আসলে কীবলতে চেয়েছিল, তা নিয়েও অনেক ভেবেছে পরে। হৈমবতী হয়তো বলতে চেয়েছিল,’টাকা পয়সা তো স্যার আপনি নিজে অর্জন করেন নি। বাবার রেখে যাওয়া টাকা পয়সা নষ্ট করছেন। সে জন্যই আপনার গায়ে লাগছে না।’ কথাটা মনে হওয়া মাত্তর, সেদিন রাত্তিরেই ও ডিসিশন নেয়, ডিটেকটিভ এজেন্সিটা গুটিয়ে নেবে।

আজ সারাদিন শপিং কমপ্লেক্সে যায়নি সায়ন। মেঘনার বাড়িতে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু লাভলির সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে ভেবে ডায়মন্ড সিটিতে ও যায়নি। ড্রয়িং রুমে বসে সায়ন টিভি দেখতে শুরু করল। সিনেমা দেখাচ্ছে ‘দাদার কীর্তি।’ অনেকটা হয়ে গিয়েছে। মহুয়া রায়চৌধুরীকে দেখতে এসেছে পাত্রপক্ষ। ছবিটা অনেকবার দেখেছে সায়ন। সিন বাই সিন ওর মুখস্থ। যতবার দেখে, ততবারই তাপস পালের জন্য ওর মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। তখন পোর মনে হয়, ভালোবাসা বলে একটা কিছু নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু আগে কখনও সায়ন ফিল করেনি।মা বলত, ‘ বেশি পড়াশুনো করে তোর মাথাটা গেছে টুটুল। তুই এত লাজুক, প্রেম করে একটা মেয়েকেও আমার কাছে নিয়ে আসতে পারলি না। বলতে পারলি না, মা একেই আমি বিয়ে করব।’

মা চলে গিয়েছে সেই কবে! সত্যি কথাটা সায়ন এখনও বলতে পারছে না। প্রেম সম্পর্কে একটা ফিলিংস ওর হচ্ছে। মানে ভেরি রিসেন্টলি এই ফিলিংসটা হতে শুরু করেছে। এমন একটা মেয়েকে ওর চোখে পড়েছে যে, ‘ বিউটি উইথ ব্রেনস’। আগে কখনও এরকম মেয়ে ওর জীবনে আসেনি। কিন্তু তাকে ফিলিংসটা জানানোর কথা ও ভাবতেও পারছে না। সেই কারণে, আরও দূরে চলে যাচ্ছে ও। টিভিতে তাপস পাল গাইছে, ‘ এই করেছ ভাল নিঠুর হে, নিঠুর হে, এই করেছ ভাল। এমনি করে হ্দয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো।’ শুনতে শুনতে মনটা খুব ভারী হয়ে গেল সায়নের। টিভির সুইচ অফ করে ও উঠে দাঁড়াল। ঠিক সেই সময় হঠাৎ ও ডোর বেলের আওয়াজ শুনল।

এত রাতে কে এল? দ্রুত পায়ে গিয়ে দরজাটা খুলতেই চমকে উঠল সায়ন।লাভলি মিত্র। পরনে ডিপ ব্লু কালারের শাড়ি। দারুণ লাগছে লাভলি মিত্রকে দেখতে। বোধহয় মেঘনার মেয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। সেখান থেকে সোজা ল্যান্সডাউনে চলে এসেছে। সায়ন মনে করতে পারল না, আগে কখনও লাভলি মিত্রকে শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখেছে কি না। ওর মুখ থেকে শুধু বেরিয়ে এল, ‘ মিস মিত্র আপনি ? আসুন, আসুন ভেতরে আসুন। লাভলি বলল, ‘ এত রাতে আসার জন্য নিশ্চয়ই আপনি বিরক্ত হননি।’ সোফায় বসে সায়ন বলল, ‘ বিন্দুমাত্র না। তবে ভাবতে পারিনি, সামান্য কারণে আপনি বাড়ি পর্যন্ত দৌড়ে আসবেন। দাঁড়ান, আমি সব রেডি করে রেখেছি। কোর্টের কাগজ পত্তর দেখে আপনি সই করে, ধীরে সুস্থে আমার ল’ইয়ার তপেশবাবুর কাছে পাঠিয়ে দেবেন।’ ‘ আপনার কথাগুলো আমি ঠিক বুঝতে পারছি না সায়নবাবু।’ না বোঝার তো কোনও কারন নেই। দু’তিনদিন আগে আপনার ম্যানেজার লাল্টু আমার কাছে এসেছিল। আমার অফিস প্রেমিসেসে আপনি যে মডেলদের গ্রুমিং সেন্টার আর জিম করতে চান, সেটা আমাকে বলেছে। আমাকেও ভয়-টয় দেখাচ্ছিল। আমি দেখলাম বন্ধু স্থানীয় কারও সঙ্গে ঝগড়া করে লাভ কী? তা ছাড়া, এমনিতেই কিছুদেন ধরে ভাবছিলাম, গোয়েন্দাগিরি আমার দ্বারা হবে না। তাই অফিস প্রেমিসেস আপনাকে ভাড়া দেওয়ার ডিসিশনটা নিয়ে ফেললাম। আপনার বিজনেস অনেক বাড়াতে পারবেন। জায়গাটা আপনার কাজে লাগবে।’

‘ লাল্টু বোধহয় একটু পরেই ফোন করবে আপনাকে।’

‘ কেন বলুন তো? ও যেভাবে লিখে দিতে বলেছিল, তপেশবাবু কোর্ট পেপারে সেভাবেই লিখে দিয়েছেন।’

‘সে জন্য নয়। ও ফোন করবে এটা বলার জন্য যে আমি ওকে দূর করে দিয়েছি। আপনিও জেনে রাখুন, ও আর আমার পার্লারের ম্যানেজার নয়। আমিও গ্রুমিং সেন্টার খুলছি না। আপনি আপনার অফিসে বসে নিশ্চিন্তে গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে যেতে পারেন।’

‘কিন্তু আমি কাল………..’

‘দুবাই চলে যাচ্ছেন, তাই তো? আপনি যাচ্ছেন না। বন্ধু বলে যখন আমাকে স্বীকার করে নিয়েছেন, আশা করে তখন আমার রিকোয়েস্ট রাখবেন। কাল আইভরি রেস্তোরাঁয় আমার সঙ্গে আপনি লাঞ্চ করছেন। আমার অনেক প্ল্যান আছে। সে-সব ডিসকাস করতে হবে। আগে আপনাকে গ্রুম করতে হবে। তার পর দু’জনে মিলে বড় কোনও ভেঞ্চার নেওয়া যায় কি না, ভাবা যাবে। কি রাজি তো?

(অদ্বিতীয়া ম্যাগাজিন বর্ষবরণ এপ্রিল ২০১২ প্রকাশিত)

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *