একুশ তলা বাড়িটা নতুন উঠেছে বাইপাসের কাছে এই বর্ধিষ্ণু পাড়াটায়। সব ফ্ল্যাট বুকিং হয়ে গিয়েছিল, স্বাভাবিক ভাবেই দেখতে না দেখতে ভরে গিয়েছে ফ্ল্যাটগুলো আর নিচের কার পার্কিং। ঝাঁ-চকচকে লবিতে সপ্রতিভ গার্ড লিফটের সামনে কেউ এলেই দাঁড়িয়ে উঠে সেলাম ঠোকে, “গুড মর্নিং স্যার” অথবা “গুড ইভেনিং ম্যাম”, যখন যেমনটা দরকার আর কি।
বাঙালীদের সাথে সাথে সমান পরিমাণ অবাঙালী বসবাস করেন এখানে। কেউ গার্ডের দিকে তাকান না। কেউ বা মুচকি হেসে মাথাটা অল্প ঝাঁকিয়ে লিফটে উঠে যান। আবার লিফট থেকে নেমেই কেউ কেউ দু’কানে ইয়ার ফোনের প্লাগ লাগিয়ে জগিং-এ রওনা দেন, বা পার্কিং-এর দিকে হাঁটা লাগান।
ভোরবেলার ব্যাস্ততাটা অন্যরকমের। বাচ্চা আর বাচ্চার ব্যাগ ঘাড়ে করে মা’ রা, স্কুলের খাতা হাতে কাঁচুমাচু মুখে টেন বা টুয়েলভের ছেলেমেয়েরা, আর মাঙ্কি-ক্যাপ কেডস জুতোয় সজ্জিত বয়স্ক দাদুদের দল সকাল সকাল বেরোয়। তার একটু পরেই কর্পোরেট সুট-বুট’ রা তাড়াহুড়ো করে ব্রেকফাস্টের বাকি আপেল চিবোতে চিবোতে মোবাইল ফোনে দুর্বোধ্য অথচ নীচু গলায় খান্না-ঝুনঝুনওয়ালা-কানোরিয়া-গনোরিয়াদের পিণ্ডি চটকাতে চটকাতে, ল্যাপটপ ব্যাগ বুকের ওপর তিরছা কায়দায় ঝুলিয়ে, দিন শুরু করার জন্য নীচে নেমে আসেন। তিরিশ থেকে চল্লিশের কোঠায় ওয়র্কিং-লেডিস’ রা লিফটে অবতরণ করেন তাদের সাথে সাথেই, অথবা একটু আধটু আগে পরে। ব্যাগের পুঁচকে আয়নায় শেষবার আই-লাইনার চেক করে, এক মহিলা অন্যজনের দিকে সোজাসুজি না তাকিয়েও, তলচোখের কোণ দিয়ে লিপস্টিকের শেডটুকু মন দিয়ে দেখে ফেলেন। মোবাইল খোলেন। সঠিক সময়টা দেখে নেন। একই সাথে সহযাত্রিণীর পার্ফিউমের ব্র্যান্ডটা কি আন্দাজ করে নিতে ভোলেন না। তবে এসবের মধ্যেই তাঁদের কলেজের প্রফেসরিতে, বা অফিস পৌঁছে সঠিক সময়ে অ্যাটেন্ডেন্স দেওয়ার ব্যাপারটা খেয়াল রাখতে হয়।
এখানকার সুপ্রতিষ্ঠিত উচ্চশিক্ষিত বাসিন্দাদের জন্য একটি নয়, একজোড়া লিফট। সবারই সুবিধে। অপেক্ষা করার ঝামেলা নেই। তবে কথাবার্তার আদানপ্রদানের সময় বা আগ্রহ বা প্রয়োজনও খানিকটা বোধহয় কম। এরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের বরাদ্দ ব্যক্তিগত ‘স্পেস’ টুকুকে খুব গুরুত্ব দেন। তাছাড়া সকলেই ভাই কাজের মানুষ, দারুণ ব্যস্ত। এঁদের অভাব শুধু একটি জিনিসের, সেটি হচ্ছে সময়।
পাশাপাশি জেনারাল লিফটে কাজের লোক, কুরিয়ারের ছেলে, মুদির দোকানের সাপ্লাই দেওয়ার মানুষরা ওঠে, নামে। সে লিফটখানা আয়তনে বড় হলেও অতটা ঝাঁ চকচকে নয়, তাছাড়া একটু আস্তে চলে। তবে জেনারাল লিফটেও এ সময়ে খানিকটা তড়িঘড়ি দৌড়। পাড়ার তিন গুজরাতি ভাইয়ের দোকান এ তল্লাটের সমস্ত বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে পঙ্গপালের মত ছোট-মেজ-ধেড়ে সাইজের ডেলিভারী-বয়’ এর দল। দুধের প্যাকেট হাতে হাতে তারা ঠিক ঠিক জায়গায় পুষ্টির সাপ্লাই দিয়ে আসে। এই বিশাল উঁচু বিল্ডিঙে তাদের সময় একটু বেশিই লেগে যায়। তবে প্যাটেল ভাইরা বিচক্ষণ। এখানে কাজটা ইস্পেশ্যাল স্পিডে করানোর ব্যাবস্থা করেন। ফুল ক্রীম, টোনড, ডাবল টোনড, সয়া, ল্যাক্টোস-ফ্রি ইত্যাদি নানারকম দুধের সাথে দৈনিক ব্রাউন-ব্রেড, মুসেলি, চকোলেট চকোস বা হেলথ ওটস’ এর অর্ডার এখান থেকেই বেশি আসে কিনা।
সকাল সকাল ডেলিভারী-বয় পল্টনের সাথে সাথেই, আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে, আঙুল দিয়ে কপালের টিপটা একটু টিপে, লিফটে উঠে পড়ে মালতী মাসি। উঠে পড়ে টুক করে বাসন-মাজুনি কলাবতী। রাতে মোদো-মাতাল স্বামীর হাতের চড়ের দাগকে মাথার ঘোমটা’ টা দিয়ে আড়াল করে, মুখে অপ্রস্তুত আধো হাসি ফোটায় সে। তাদের সাথে লিফটে উঠে বোতাম টেপে জয়ন্তী সোরেন। বস্তি থেকে খুব পা চালিয়ে এলেও এক আধদিন মিনিট পাঁচেক দেরী হয়ে যায়। ন’ তলার মাসীমার বেডপ্যান দেওয়ার সময় হয়ে যায়। তাই ঠিক সময়ে পৌঁছোবার চেষ্টা করে জয়ন্তী। মাসীমা’ র বউমা নিশ্চয়ই ততক্ষণে তাঁকে হর্লিক্সের গ্লাস ধরিয়ে নিজে কাজে বেরনোর জন্য তৈরি হচ্ছে। নিম্নচাপ আটকাবে কি করে প্যারালাইস বুড়িমা!
“কেয়া রে বাবু, এ বছর এত্ত ঠান্ডা পড়েছে। দিন রাত্তির কাশতে থাকিস। পায়ে মোজাও পরিস নি আজ!” জেনারেল লিফটে ষোলোতলায় ঝাড়ু-পোঁছা করতে যাবার আগে ডিমের প্যাকেট হাতে বছর এগারোর বুধনের খোঁজ নিয়ে নেয় সুখিয়া দিদি।
“এই নে, আমার মোজাই পরে নে আজ” লিফটেই এক-পায়ে, কখনও দু-পায়ে, ব্যালেন্সের এক্কা-দোক্কা খেলতে খেলতে মোজা খুলে ছেলেটাকে হাতে ধরিয়ে দেয় সে।
“কিউ দিদি?” লজ্জা লজ্জা করেও সে দুটো নিয়ে নেয় বুধন। কনকন করতে শুরু করছে পা দুটো। এক সপ্তাহ জ্বরের পর ভোরবেলা রাস্তায় বেরোতে না বেরোতেই হাত-পা-মাথা ব্যাথা করে তার। অথচ পুরনো মোজায় যে বড় বড় গর্ত হয়ে গিয়েছে।
“আরে, মুঝে তো ফ্ল্যাট মে ঘুসতেই ঝাঁটা নিয়ে ঝারু মেরে, ঘরগুলো মুছতে শুরু করতে হবে। মোজা ভিজতে দু মিনিট। তুই পড়ে ফ্যাল। তবে, কাল ইস টাইমে ফেরত না দিয়া তো তোর হবে এক চোট”, শাসাতে ছাড়েনা সুখিয়া দিদি। পেছন ফিরে তার দিকে একবার তাকিয়ে হেসে ন’তলায় নেমে যায় বুধন।
সকাল ফুরোলে গার্ড মশাইয়ের একটু বিশ্রাম। ‘গুড মর্নিং’ করারও বিরতি। ড্রাইভার ভাইরা আস্তে-ধীরে ডিউটিতে আসে। বাড়ির বউদিদের থেকে চাবি-টাবি নিয়ে এসে, পার্কিং-এর গাড়িগুলোকে স্নান, শ্যাম্পু করিয়ে ঝকঝকে করে ফেলে তারা।
“আরে শম্ভু কাকা, মেয়ের বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেছে তো? গোটা মাস ছুটি করে ফিরলে!?” বাবুর নতুন ইন্ডিকা’ র মাডগার্ডের থেকে খুঁটে সব কাদা সাফ করে জিজ্ঞেস করে গোপাল।
“হ্যাঁ রে ভাই। কিন্তু ই মাসটা কি করে যে চালাব! সাহেব মানুষটা ভালো। দশ দিনের টাকা অ্যাডভান্স দিয়েছেন। কিন্তু আমার ছেলের বৌটা পোয়াতি। এদিকে ছেলেটার চাকরি নেই, ফ্যাক্টরিটা বন্ধ হয়ে গেল। বৌ’ টাকে এমন সময় খেতে না দিলে বাচ্চা বাড়বে কত্থিকে!” শম্ভু কথা বলে আর উইন্ড-স্ক্রীনের কাচ মোছে।
হাতের কাজ সেরে লখিন্দর এগিয়ে আসে এবার। ‘কেয়া বাত হ্যায় চাচা? ফিকর ছোড়ো। ইয়ে লো। তুমহারে জেব মে কুছ রাখো। আমার গুড্ডি যখন হাসপাতালে দাখিল হয়েছিল, তুমিই তো সাথে ছিলে, বলেছিলে, “লখু রে, হম মদত করেঙ্গে। তেরে বেটি কো কুছ নহী হোনে দেঙ্গে।” উস বার ডেঙ্গু মে বহুত বচ্চে মরে থে। মেরে বিটিয়া আজ দস সাল কি হো গই। জানতে হো চাচা, আজ উসকি জনমদিন’! দিন গড়িয়ে দুপুর শেষ হতে না হতে ভ্যাঁ-কান্না জুড়ে স্কুল বাস থেকে নেমে আসে পাঁচতলার শালিনী দিদিমণির ছ’ বছুরে টিয়া। সবাই জানে শালিনী ম্যাডাম একাই থাকে। ব্যাঙ্কে খুব বড় কাজ করে। বেরিয়ে যায় সকাল সকাল, ফিরতে সেই সন্ধ্যে। সকালে টিয়া’ কে টিফিন, জলের বোতল আর ব্যাগ শুদ্ধু বাসে তুলে দিতে হয় যামিনী মাসীরই। বারো ঘণ্টার কাজের লোক সে, সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা অবধি সে-ই সংসার করে ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে। কাঁখে টিয়া, পিঠে ব্যাগ ফেলে লিফটের সামনে এসে একটু হাঁপায় যামিনী মাসী।
“গুড়িয়া বড় হয়ে গেছে মাসী, ওকে কোলে নিয়ে কষ্ট হয় না তোমার!” বলে ফেলে ডিউটি বদল রোগা কালো গার্ড শ্যামল। কুরিয়ার দিতে আসা খেঁকুরে চেহারার ছেলেটা শ্যামলের বোতল থেকে আলগোছে একটু জল খেয়ে নিয়ে মাথা নেড়ে সায় দেয়।
“কলাগাছের কাছে কি কলার কাঁদি কখনও ভারী লাগে রে, ছোঁড়া! কক্ষণও না।”
লিফটের দরজা বন্ধ হলে যামিনী মাসী টিয়াকে নিয়ে স্নান-খাওয়া করাতে ওপরে চলে যায়।
বিকেল বিকেল মাথার-ওপর-খাড়া-চুল স্যান্ডি কলেজ থেকে ফেরে। নীচে লেটার বক্স ঘেঁটে আজব সুরে গান গাইতে গাইতে এদিক ওদিক একটু দেখে সাত-তলায় রওনা দেয়। তার পরপরই কপালের ওপর সানগ্লাস চড়িয়ে জিন্স পড়া অল্পবয়েসী সুইটি ভাটিয়া দিদিমনি লিফটের সামনে এসে বোতাম টেপে। পড়াশুনা সেরে ফিরে আসে, তাই তারও পিঠে কলেজের ব্যাগ। কানে তার ঝোলানো, হাতের মোবাইলে খুটখাট, দুচোখের দৃষ্টিও সেখানেই বন্দী। কার সাথে কি লেনদেন হচ্ছে বোঝার উপায় নেই। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে পোশাক বদলে নেমে আসে। টাওয়ার বিল্ডিং’ টাকে প্রদক্ষিণ ক’ রে বনবন করে হেঁটে বেড়াতে থাকে। সাড়ে চার পাক পরেই ট্র্যাক-প্যান্টের পকেট থেকে আবার বেরিয়ে আসে মোবাইল। মন দিয়ে কি যেন পড়ে নেয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই, এই বিল্ডিং’ এ যারা বসবাস করে, তারা প্রত্যেকেই প্রায় একটি হোয়াটস আপ ‘রেসিডেন্ট’ স গ্রুপ চ্যাট’ এর মেম্বার। সুবিধে-অসুবিধে ব্যক্ত করার জন্য সব বাসিন্দাই মোবাইলে এখানে দরকারী ব্যাপার লেখালেখি করতে পারে। তবে আকাশ ছোঁয়া বাড়ির গ্রুপ চ্যাটে আবাসনের বাসিন্দাদের ফোন নম্বর থাকলেও সবাই ‘ফেসলেস’। অর্থাৎ চ্যাটে কারও ছবি-টবি দেওয়ার বালাই নেই। কেউ কারও নিজস্ব চেহারা প্রাইভেসির আড়াল ভেঙে প্রকাশিত করতে ইচ্ছুক নন। তাছাড়া বেশির ভাগ বাসিন্দাই শুধু কন্ট্যাক্ট নম্বরটি দিয়েই দায়িত্ব পালন করেছেন, পুরো নাম-ধাম লিখতে আগ্রহী নন। তবে চ্যাট জোরদার চলতে থাকে। বিল্ডিঙের জেনারেটর আজকাল পিক-আপ নিতে কেন সময় বেশি লাগাচ্ছে, উইকেন্ডে চারতলার মধ্যরাতের পার্টি রাত তিনটেয় শেষ হওয়াতে ষষ্ঠ ফ্লোরে কার মাইগ্রেনের ব্যাথা অসহ্য হয়ে উঠেছিল, নীচের তলায় ছোট্ট পার্কের চারপাশে পোষা কুকুরদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার নামে চুপিচুপি হাগু করিয়ে যে পার্কের শোভাবর্ধন করা যায়না, এসব কাজের কথা তো হতেই থাকে।
যাই হোক এ সময়ে স্যান্ডি চ্যাটে কি ভেবে লিখে ফ্যালে, ‘’সর্ট অফ সাফোকেটিং ওয়েদার টুডে। আই জাস্ট হ্যাভ টু গো ডাউন আগেন। ইভেন মাই ডগি মাস্ট হ্যাভ সাম ফ্রেস এয়ার।’
নিজের ‘ওয়ক’ সেরে ওপরে যাওয়ার আগে তাই সুইটি এসে মিনিট দুয়েক এক নম্বর লিফটের সামনে দাঁড়ায়। লিফটের বোতাম লাল হয়, দেখতে দেখতে নীচে নেমে আসবে নাকি স্যান্ডি আর তার স্প্যানিয়েল! কিন্তু পরিচিতির জন্যে তো মুখ চেনাটুকু আর অল্পস্বল্প আলাপ দরকার। পনিটেলের রবার ব্যান্ড’টা খুলে লিফটের সামনে দু চারবার ঘোরাঘুরি করে সুইটি। নামছে না তো কেউ! এক সময়ে বোর হয়ে ওপরে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় সুইটি। ‘স্যান্ডি’ নামটা কি রোম্যান্টিক! কিন্তু ছেলেটা দেখতে যে ঠিক কেমন, তা আর শিগগিরই জানা হয়ে ওঠেনা ।
ততক্ষণে দুই নম্বর লিফট পাশাপাশি নেমে পড়েছে। দরজা দিয়ে অমনোযোগী কে যেন বেরিয়ে এসেছে কুকুর ছাড়াই। বাইরে বেরিয়ে এদিক ওদিক কাউকে খুঁজে না পেয়ে ধা করে লিফটে আবার ঢুকে পরে সে কুকুরকে বের করে আনতে। পোষা চার্লি একটু হকচকিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নীচের লবিতে ইতস্থত ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সেখানকার আবহাওয়াও কিছুক্ষণ পরে ‘সাফোকেটিং’ লাগতে থাকে বেচারা স্যান্ডি’র। বিরস লাগে উদ্দেশ্যহীন প্রতীক্ষার সময়টুকু।
সন্ধ্যে হলে ঘরে-ফেরা-কর্মরতা মা’ রা বাড়ি ফেরেন। সারাদিনের শেষে বহুতলে ওঠার জন্য লিফটে চড়ে যার যার নিজস্ব ফ্লোরের বোতাম টিপে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রায় কেউই বুঝতে পারেননা এটুকু প্রতীক্ষার সময় কি ভাবে কাটানো যায়। তাই হাতব্যাগগুলো থেকে বেরিয়ে আসে ছোট ছোট কালো মুঠোফোন। নিঃশব্দ অপেক্ষায় তারা সময়টুকু কাটিয়ে দেন। নির্দিষ্ট জায়গায় লিফট থামে। যন্ত্রগুলো হাতে নিয়ে যন্ত্রেরা যন্ত্রযান থেকে নেমে যায়।
কম্পাউন্ডের ভেতরের বাস্কেট-বল কোর্টের পাশে ছোট্ট জিম সে সময়ে বেশ সরগরম। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে বেরিয়ে এসে নিজের বাইসেপ্স দুটোতে হাত বুলোয় রোহণ কিচলু।পায়চারী করতে করতে সে-ও কার উদ্দেশ্যে যেন মোবাইলে গ্রুপ চ্যাটে লিখে ফেলে, ‘গ্রেট ওয়ার্ক আউট, গোয়িং হোম।’
ততক্ষণে পনেরো তলার শম্পা সেন নিজের ফেসবুকের স্ট্যাটাস বদলিয়ে আর একবার ‘ইটস কমপ্লিকেটেড’ লিখে ফেলেছে। একটু দেরী হয়ে গেলো। বড় একটা শ্বাস ফেলে এবার সে নতুন নাইকি’ র ট্রেনারের ফিতে বেঁধে ফেলে। চটপট নীচে যেতে হবে তার। ফ্ল্যাটের চাবি পকেটে ঢোকায় সে, দরজা টেনে বন্ধ করে লিফটে অবরোহণ করে। ওদিকে অপেক্ষা আর ভালো লাগেনা। পাশের লিফটে আরোহণ করতে করতে অর্ধেক উর্ধগতির পথ পেরিয়ে মনঃক্ষুন্ন রোহণ গায় ‘তেরে বিনা ক্যায়সে জিনা’। মনে মনে ভাবতে থাকে শ্যামলী রঙের, দীঘল কালো চোখের মেয়েটি কি এই সময়ে গ্রুপ চ্যাটে চোখ রাখেনা! সেই কবে যে এক্সারসাইস করতে গিয়ে দেখে হয়েছিল একবার!
‘স্কাই টাচ’ টাওয়ারের মধ্যবয়েসিনী মহিলার মনে হচ্ছে শীত শেষের স্পেশ্যাল বৃষ্টিটা আজই হয়ে যাবে।তাই তিনি মাটির সোঁদা গন্ধ মিস করতে চান না। লিফটে নামতে নামতে গুনগুন করে গাইছেন, “মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো”।কদিন ধরে কম্পাউন্ডের গ্রুপ চ্যাটে মেঘ মজুমদার নামে এই লোকটাকে দেখতে বেশ ইচ্ছে করে। তবে নামটার সাথে সাথে চেহারাটার আন্দাজ পাওয়ার কোন চ্যান্স নেই। হোয়াটস আপে নামের পাশে এক দূরের পাহাড়ের ছবি! বোধহয় স্মার্ট ভাঁওতা কোনও।
এরই মধ্যে, কাত করা মাথা আর ঘাড়ের মাঝখানে প্রাণপণে একটা দারুণ অ্যাঙ্গেলে ধরে রাখা মুঠোফোনে দিনের শেষ ক্লায়েন্ট’ কে ‘গুড নাইট’ বলে নয়তলা থেকে লিফটটাকে নীচে ডেকে পাঠান মেঘ মজুমদার। একা মানুষ। ঘরে ফেরার টান না থাকলেও বাইরের আবহাওয়াটা আজ দারুণ। গাড়িতে ফিরতে ফিরতে লক্ষ করেছেন, আকাশের বুকে অল্প বিদ্যুৎ’ এর ঝিলিক দেখা দিচ্ছে! যদিও সঙ্গী নেই, মিউজিক প্লেয়ারে জয়জয়ন্তী চালিয়ে একাই বারান্দার চেয়ারে সিংগল মল্ট হাতে বসে থাকা যাবে নাহয়।
চলন্তিকা বাক্সে অবতরণ করে ওপর দিকে তাকিয়ে থাকা অল্প টেকো লোকটাকে অপাঙ্গে একবার দেখে নেন মনামী রয়। নাঃ, দুচোখের দৃষ্টিতে মেঘলা আভাস রইলেও এ সেই মেঘ মজুমদার বোধহয় নয়। মোবাইলে খুটখাট করতে করতে হাঁটা দেন তিনি, গুনগুন করেন আপন মনে, ‘তাহারে দেখি না যে দেখিনা, শুধু মনে মনে ক্ষণে ক্ষণে ওই শোনা যায়’।
কার ফেলে রেখে যাওয়া অঙ্গসৌরভে অল্প একটু আনমনা হতে হতে ওপরে উঠতে থাকেন মেঘ।