ফুলে ফলে বাড়ুক ত্বকের জেল্লা

রূপচর্চায় ফুল ও ফলের ব্যবহার নতুন কিছু নয় বরং বহু প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। পাশাপাশি এর অবদানও অপরিসীম। তবে কর্মব্যস্ত জীবনে প্রায়শই রূপচর্চায় টাটকা ফুল ও ফলের ব্যবহার সম্ভব হয়ে ওঠে না। বরং সেক্ষেত্রে বাজার চলতি কেমিক্যাল যুক্ত প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে বাধ্য হয় সাধারণ মানুষ। কারণ সময়ের অভাব! কিন্তু এর ফলে পরবর্তী সময় ত্বকের নানা সমস্যার সম্মুখীন হন তাঁরা। সেক্ষেত্রে ত্বকবিশেষজ্ঞদের মতে একটু বাড়তি সময় বের করে যদি ত্বকচর্চায় সতেজ ফুল ও ফলের ব্যবহার করা সম্ভব হয়, তাহলে খুব কম সময়ে ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা থেকে স্বল্প খরচেই মিলবে সমাধান। তাই আপনাদের জন্য রইল ফুল ও ফল দিয়ে রূপচর্চার বিভিন্ন টিপস।

রূপচর্চায় ফুলের ব্যবহারঃ

গাঁদা ফুল

এই ফুলে আছে অ্যাণ্টিসেপটিক ও অ্যাণ্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান। তাই যারা মুখের ব্রণ বা কালছে দাগছোপের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য এই ফুলের রস খুবই উপকারী। গাঁদা ফুলের পাপড়ি বেটে, এতে অল্প কমলালেবুর রস, চন্দনবাটা দিয়ে প্যাক বানিয়ে যেখানে যেখানে ব্রণ হয়েছে সেখানে লাগান। দেখবেন ধীরে ধীরে ব্রণ শুকিয়ে আসছে। যদি কালো দাগছোপ থাকে তাহলে গাঁদা ফুল বেটে তার সঙ্গে এক চামচ টক দই, নারকেল তেল, দু ফোঁটা লেবুর রস আর এক চামচ মধু মিশিয়ে লাগালে দাগছোপ দূর হবে।

গোলাপ ফুল

গোলাপ না-পসন্দ, এমন ফুলপ্রেমী প্রায় বিরল। রূপ ও গন্ধে মাতোয়ারা এই ফুলটি রূপচর্চায় ব্যবহার হয়ে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। ত্বকবিশেষজ্ঞদের মতে এই ফুলটি স্ট্রেচ মার্ক, ত্বকের কালো দাগ ছোপ, সান বার্ন ও বলিরেখা দূর করে। কারণ এই ফুলটি আর্দ্রতায় ভরপুর। তাই এর পাপড়ি বেটে কাঁচা দুধে মিশিয়ে তার মধ্যে এক চামচ মধু যোগ করে প্যাক তৈরি করুন। তারপর সেই প্যাকটি মুখে লাগিয়ে ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে তিনদিন এর ব্যবহারে রুক্ষ ত্বকের মিলবে সমাধান। টোনার হিসেবেও গোলাপের জল খুব ভালো।

রজনীগন্ধা

শুষ্ক, রুক্ষ ত্বকে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারে এই ফুল। পুরো ফুটে যাওয়া রজনীগন্ধা ফুলের পাঁপড়ি বেটে নিন। এর সঙ্গে সামান্য মাখন ও মধু মিশিয়ে ত্বকে ম্যাসাজ করুন। ২০ মিনিট পর ঠান্ডা জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।

পদ্ম

এই ফুলের পাপড়িতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’, ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স, আরও বেশকিছু অত্যাবশ্যকীয় খনিজ পদার্থ। এটি তৈলাক্ত ত্বকের লোমকূপ বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ব্রণের সমস্যায় কার্যকর এছাড়াও অকাল বার্ধক্য রোধ করে এবং ত্বক কোমল রাখে পদ্ম ফুলের প্যাক। পদ্ম ফুলের পাপড়ি, মধু এবং অ্যালোভেরা জেল দিয়ে একটি ফেস প্যাক তৈরি করুন। তারপর তা গোটা মুখে ভালো ভাবে ম্যাসাজ করে মেখে নিন। মিনিট ১০ রেখে মুখটা ভালো করে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে একদিন এর ব্যবহারে ত্বকের সমস্যার মিলবে সমাধান।

জবা ফুল

জবাফুল মূলত চুলের জন্য ভালো আমরা প্রায় প্রত্যেকেই জানি। কিন্তু আপনারা জানেন কি, এই ফুলটি ত্বকের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। জবা ফুল প্রাকৃতিক বোটক্স হিসেবেও পরিচিত। আর এই ফুলের নিয়মিত ব্যবহারে ত্বকে সহজে বয়সের ছাপ পড়ে না। ফুলের পাপড়িতে রয়েছে প্রচুর পরিমানে অ্যাণ্টিঅক্সিডেন্ট এবং আলফা হাইড্রক্সি অ্যাসিড। জবা ফুলের পাপড়ি বেটে ফেসমাস্ক হিসেবেও ব্যবহার করতে পারেন।

বেলিফুল

বেলিফুল থেঁতো করে নিন।তারপর এর সঙ্গে অ্যালোভেরার রস ও মধু মিশিয়ে ত্বকে লাগান। ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। ত্বক টানটান ও মস্ণ হয়ে উঠবে। নিয়মিত ব্যবহারে বলিরেখা দূর হবে।

জুঁই

জুঁই ফুলের মন মাতানো মিষ্টি গন্ধের সঙ্গে ত্বকের নানা উপকারেও এর জুড়ি মেলা ভার। এর নির্যাসে তৈরি এসেনশিয়াল অয়েল ত্বকের রুক্ষ এবং শুষ্ক ভাব দূর করতে সাহায্য করে। এটি যে কোনও ধরনের ত্বকের জন্য কার্যকর। সংবেদনশীল ত্বকেও এটি ব্যবহার করা যায়। এর মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বলি রেখা প্রতিরোধ করে এবং ত্বকে সহজে বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না। কিছুটা জুঁই এর পাপড়ি থেঁতো করে নিয়ে তাতে এক চা চামচ দুধ এবং বেসন মিশিয়ে ফেস প্যাক তৈরি করে নিয়ে মুখে লাগান। ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। আপনার ত্বক উজ্জ্বল দেখাবে।

কাঠ গোলাপ

কয়েকটি কাঠ গোলাপ ফুলের পাপড়ি নিন। এর সঙ্গে দুতিন চা-চামচ ওটস আর দুধ মিশিয়ে ভালো করে ব্লেন্ড করে নিন। নরম কাপড়ে বা তুলোয় গোলাপ জল ভিজিয়ে পুরো মুখ মুছে তারপর কাঠ গোলাপের ফেসপ্যাকটি লাগান। ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর ঠান্ডা জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এই প্যাক নিয়মিত ব্যবহারে ত্বকে জেল্লা ফিরে আসে। যে কোনও বয়েসে শুষ্ক ত্বকের সমস্যার সমাধানে কাঠ গোলাপের এই প্যাকটি লাগাতে পারেন।

শাপলা ফুল

মিনারেলের সঙ্গে শাপলা ফুলে আছে লিনেলিক অ্যাসিড, যা ত্বকের রঙ উজ্জ্বল করে। প্যাকটি তৈরি করা খুব সহজ। ফুলের পাপড়িগুলো ভালো করে ধুয়ে জলে ৪ মিনিট সিদ্ধ করে নিতে হবে। পাপড়ির পেস্ট বানিয়ে তাতে টকদই আর মধু মিশিয়ে ত্বকে লাগান। তবে খেয়াল রাখবেন সেনসিটিভ ত্বকে কিন্তু ব্যবহার করা যাবে না।

রূপচর্চায় ফলের ব্যবহারঃ

কমলা লেবু

কমলায় থাকে ভিটামিন-সি। আর ভিটামিন-সি দেহের জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি উপাদান।শুধুমাত্র দেহের জন্য নয় ভিটামিন-সি ত্বকের জন্যও উপকারী। এটি ত্বককে দৃঢ় রাখে। এছাড়া এতে বিদ্যমান রয়েছে এন্টিঅক্সিডেন্ট, যা ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে থাকে। তৈলাক্ত ত্বকের জন্য কমলা খুবই কার্যকারী একটি ফল।

পেঁপে

ত্বকের কালছে ভাব দূর করতে পেঁপের জুরি মালা ভার। এর ভিটামিন সি ত্বকের রোদে পোড়াভাব দূর করে। প্রতি সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ বার এই ফলটির নরম পাকা অংশ হাতের তালুতে চটকে নিয়ে মুখে, ঘাড়ে, হাতে এবং পায়ে মেখে নিন। শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।তারপর ঠান্ডা জল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলুন। এক সপ্তাহেই ত্বকের পরিবর্তন দেখতে পাবেন।

ফুটি

মৌসুমি ফলের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে মুখের ত্বক পরিষ্কার করতে ফুটির জুড়ি মেলা ভার। ফেসওয়াশ ব্যবহারে যাঁদের ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়, তাঁরা বিকল্প হিসেবে ফুটির ব্যবহার করতে পারেন। এক্ষেত্রে এক টেবিল চামচ ফুটির পেস্ট নিয়ে এর সঙ্গে এক টেবিল চামচ দুধ ও এক চা-চামচ মধু মেশান। এই প্যাকটি ত্বকে লাগিয়ে ২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। তৈলাক্ত ত্বকে রোদে পোড়া ভাব দূর করতে ফুটির সঙ্গে লাল আটা মিশিয়ে ত্বকে লাগালে উপকার পাবেন। এছাড়া শুধু ফুটি জুস করে তুলোয় ভিজিয়ে মুখে লাগালেও উপকার পাবেন।

আম

আমের মধ্যে আছে ভিটামিন ‘বি’ ও ‘সি’, যা ত্বকে গভীর ভাবে পরিস্কার করে। তাই ত্বক পরিষ্কার রাখতে পাকা আমের কাথের সঙ্গে ওটমিল দিয়ে তৈরি মিশ্রণ যেকোনো ধরনের ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন। যাঁদের ত্বক তৈলাক্ত, তাঁরা সান বার্ন বা রোদে পোড়া দাগ দূর করতে পাকা আমের সঙ্গে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে নিন। তা ছাড়া হাত ও পায়ের মরা কোষ তুলতে আমের সঙ্গে চালের গুঁড়ো মিশিয়ে ত্বকে লাগাতে পারেন। মিশ্রণটি ত্বকে শুকিয়ে এলে হালকাভাবে হাত দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করে জল দিয়ে ধুয়ে নিন।

আপেল

আপেলে রয়েছে ভিটামিন-এ এবং সি।ত্বকচর্চায় আপেল খুবই উপকারী একটি ফল।এতে রয়েছে এন্টিঅক্সিডেন্ট।যা ত্বকের ব্রণ দূর করতে সাহায্য করে এবং শুষ্ক ত্বকের সুরক্ষায় মসৃণ করে।

স্ট্রবেরি

স্ট্রবেরিতে রয়েছে স্যালিসিলিক অ্যাসিড। যা ত্বকের যত্নে কার্যকর। স্যালিসিলিক অ্যাসিড একটি এন্টিব্যকটেরিয়াল উপাদান। যা ত্বককে ব্যাকটেরিয়ার হাত থেকে রক্ষা করে থাকে।স্ট্রবেরি ত্বক পরিষ্কার করে থাকে।তাছাড়া স্ট্রবেরি সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির প্রতিক্রিয়া থেকেও ত্বককে রক্ষা করে থাকে।

অ্যাভোকাডো

অ্যাভোকাডোতে রয়েছে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি।যা ত্বকের যত্নে অতি গুরুত্বপূর্ণ।এতে আরও রয়েছে ভিটামিন-এ,বি৩,বি৬,সি,কে।এতে লুটিন রয়েছে যা সূর্যের রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করে থাকে।

চেরি

চেরি ত্বকের জন্য অনেক প্রয়োজনীয়।এতে রয়েছে ভিটামিন-এ, সি এবং কে।যা ত্বককে উজ্জ্বল করতে সাহায্য করে। এছাড়াও এই ফলটিতে রয়েছে এন্টিঅক্সিডেন্ট ও  অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, যা ত্বকের ভাঁজ দূর করে ত্বককে জীবাণু মুক্ত করতে সাহায্য করে।

কলা

শুধু কলার ভেতরের অংশ নয়, কলার খোঁসাও ত্বকের জন্য অধিক কার্যকর।কলায় রয়েছে ভিটামিন-এ, সি, ই এছাড়াও রয়েছে প্রচুর পরিমানে মিনারেল। তাছাড়া ফাইবারে পরিপূর্ণ এই ফলটি ত্বককে করে তোলে নরম এবং জীবাণু মুক্ত।

আঙ্গুর

এই ফলটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন-সি ও মিনারেল। এন্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর এই ফলটি ত্বক পুনর্নির্মাণে সাহায্য করে থাকে।এছাড়া আঙ্গুরে যে সকল উপাদান রয়েছে, সেগুলো ত্বক উজ্জ্বল করতে সাহায্য করে।

জামরুল লিচু

 

শসার মতো জামরুল ও লিচুর রসও সব ধরনের ত্বকেই প্রাকৃতিক ক্লিনজার হিসেবে কাজ করে। জামরুল অথবা লিচু থেঁতো করে রসটুকু বের করে নিন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তুলা দিয়ে রসটুকু পুরো মুখে লাগিয়ে ২০ মিনিট অপেক্ষা করুন। তবে যাঁদের ত্বক শুষ্ক, তাঁরা লিচুর রসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে নিতে ভুলবেন না।

সবেদা

ত্বকের বলিরেখা দূর করতে জাদুর মতো কাজ করে এই ফলটি। প্যাক তৈরি করতে সবেদার সঙ্গে ডিমের সাদা অংশ মিশিয়ে নিন। একটু বয়স বাড়লে ত্বক ঝুলে যাওয়ার যে সমস্যা দেখা যায়, এটি দূর করতে সাহায্য করে এই প্যাকটি।

কাঁঠাল

অনেকের শরীরে কালো ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়। এধরনের সমস্যায় কাঁঠালের রসের সঙ্গে দুধ ও মধু মিশিয়ে পুরো শরীরে লাগাতে পারেন। যাঁদের ত্বক একটু বেশি শুষ্ক, তাঁরা দুধ ও মধুর পরিবর্তে তিলের তেল ব্যবহার করুন। একটু আঠালো হলেও ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে বেশ কাজ করবে এই মিশ্রণটি। তবে কাঁঠালের গন্ধ যাঁরা একেবারেই সহ্য করতে পারেন না, তাঁরা এটা ব্যবহার না করলেই ভালো করবেন।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *