১
কিন্তু তারপর?
তার আর পর কি। কিছুই না। পৃথিবী যেমন আছে ঠিক তেমনই থাকবে। শুধু বিকেলগুলো পোশাক বদলাবে। দেওয়াল ফুঁড়ে যদি ডাইনোসরও চলে আসে আমি তেমনি অবাক থাকব। আর তুমি নির্বাক। এক বাক্স ভর্তি গল্প ফুড়িয়ে এলে তুমি কবার্ড খুলবে, রাত নামার আগে ট্রেনের হুইসলের মতো একটা গান একান্তে গাইতে চাইলেও চুপ হয়ে যাবে তখনকার মতো। আচ্ছা ধরো, এই মুহুর্তে তুমি একটা পাখি হয়ে গেলে। তারপর উড়তে থাকলে ঘরের ভেতর… কোনটা দরজা আর কোনটা জানলা… বুঝে উঠবার আগে আয়নায় মাথা ঠুকলে। তারপর জানলা দিয়ে ফুড়ুৎ। না সে হওয়ার জো নেই এখন। সামনে দেওয়াল। আর দেওয়ালের ওপারে আরও দেওয়াল। তার চেয়ে তুমি কবার্ড থেকে স্বপ্ন বের করো। তারপর দু-দান দাবা খেলতে বসো। আমি বলব ভেনিস এখন আমার মাথায় ভর করেছে। আমি সারা রোম জুড়ে খুঁজে ফিরছি সুইট ড্রিম। এক বার পা বাড়ালেই হল। শহর থেকে শহর…
বাইরে তাকিয়ে একবার দেখে নাও বৃষ্টি এসেছে, না থামতে বোলো না। বৃষ্টি থেকে গা বাঁচিয়ে সিগারেটে টান দাও, চাইলে এক কাপ কফি পান। পথ এই বৃষ্টিতে পথের হাত ধরে হাটতে বেড়িয়েছে। আসলে সব কেমন হ্যালুসিনেশন। তোমার গান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টিকটিকি মাথা তুলে চাইবে। আরশোলা ফড়ফড় করে উড়বে। তবু তুমি গাইবে।
হ্যাঁ, এসবই অরন্যের মাথায় ঘুরতে থাকে সবসময়। এই ছবি আঁকে তো এই গান গায়। আবার পরক্ষণেই ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আসলে যে কি করতে চায় নিজেই জানে না। এই চলছিল গত চার বছর ধরে। অরণ্য মানে একটা গোটা আকাশ। একটা গোটা শহরও বলতে পার। এই আমি অদৃকা, আজ দু-বছর তার থেকে দূরে থাকার পর, আবারো এই শহরে পা রেখেছি গতকাল ভোরে। এই ফিরে আসাটাও অদ্ভুত। অনেক ঝড় ঝাপটা, অনেক বাক-বিতন্ডার পর শেকল ছিড়ে আসতে পেরেছি দেশে। আর দেশে ফিরে আসা মানেই যে শুধু অরণ্যের জন্যে, এটা সবাই বুঝতে পেরেছে।
২
সবে আমাদের বিয়ে হয়েছে তখন। অরণ্য চাকরী করত আইটি ফার্মে। সেখান থেকেই পরিচয়। একদিন বাসে করে যাওয়ার সময় অরণ্যের পার্স চুরী হয়ে যায়। তারপর সেই এগিয়ে গিয়ে বিব্রত অরণ্যকে বাস ভাড়ার টাকাটা দেয়। সেই সঙ্গে এটাও বলে যে সময় মতো ফিরিয়ে দিতে। ফোন নম্বরটা অবশ্য দিতে ভোলে না। তারপরই একদিন ফোন আসে। সকালে কাজের সময় অনেকবার অচেনা নম্বর থেকে রিং হওয়ার পর অদৃজা ফোন ধরে। বেশ সুন্দর একটা গলার আভাস পেয়ে তার ভালো লাগে কথা বলতে। তারপরই অরণ্য নিজের পরিচয় দিয়ে বলে যে, আজ বিকেল ৫টায় কি মাননীয়ার সিসিডিতে যাওয়ার সময় হবে, সেদিনকার ঘটনা মনে পড়তেই অদৃজা হ্যাঁ বলে দেয়। সেই কফি হাউসের মিটিং তাঁদের চলতেই থাকে টানা দু-বছর। শেষে দুজনের বাড়ির মতেই বিয়েটা হয়ে যায়।
বেশ চলছিল তাঁদের সংসার জীবন। দুজনের অফিস, দুই বাড়ি মিলে গেট টুগেদার। পুজো বলো, কিম্বা ঈদ, দুজনের বাড়িতেই হইহই। এখানে ওখানে ঘুরতে যাওয়া তো আছেই। বলতে গেলে বেশ জমাটি ব্যপার।
সেবার ঘুরতে গিয়েছে দুজনে। শিমলাতে। চারদিকে সবুজ পাহাড়। নদী। বরফ দেখতে দেখতে আত্মহারা হয়ে গেছে দুজনেই। বিশেষ করে অরণ্য। ও তো পাগল প্রায়। এখানে যাব, ওখানে যাব, এই করব। ওই করব। একেবারে অস্থির করে দিচ্ছিল অদৃজাকে। একটু বেশীই প্রকৃতি প্রেমী অরণ্য। সেদিন রাতে তাঁরা রাতের শিমলা দেখতে বেড়িয়েছিল। কারণ রাতটা ছিল পূর্নিমার। যা অরণ্যের ভীষন পছন্দের। তাই আনরোমান্টিক আমাকেও বেরোতে হল। কারন বরাবরই স্ট্রেটকাট আমি, এসব আদিখ্যেতা খুব একটা পছন্দ ছিল না। হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে আমরা আটটার দিকে বেরোলাম বাইরে। এক অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ তখন। চাঁদের আলোও চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে। হোটেলের কেয়ারটেকার খুব বেশি দূরে যেতে বারণ করে দিয়েছিল পই পই করে। আমিও কেন জানি না ভয় পাচ্ছিলাম। শিউড়ে ওঠা জ্যোৎস্না বুঝি একেই বলে। ভাবছিলাম আর আনমনে লনের পাথুরে পথ দিয়ে হাঁটছিলাম। অরণ্য কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে আমাকে রেখেই। ও একটু এগিয়ে যাচ্ছে বলেই, আমিও পা চালিয়ে ওর পাশে হাঁটতে লাগলাম। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে দুজনেই হোটেল ছাড়িয়ে অনেক দূরে এসে পড়েছিলাম। এখানে হাইওয়ে বলতে যা বোঝায়, ওই পাহাড়ী পথ, তারপরই খাড়া ঢাল। আমি ভয়ে অরণ্যের হাত ধরে আছি। ক্রমাগত বলছি এবার ফিরে চলো, অনেক রাত হয়ে গেছে। কিন্তু অরণ্য বলেই চলেছে অনেক কথা।
“আটলান্টিকের উপর দিয়ে উড়ে চলেছে পক্ষীরাজ। ভীষণ বরফ ঝড় শুরু হয়েছে। বড়, বড় ঢেউ সমুদ্র ফুঁসে একদম আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে। থরথর করে কাঁপছে পক্ষীরাজ। আমি চাঁদ দেখতে পাচ্ছি না। আর যতই হাতটা মুঠো করছি না কেন মনে হচ্ছে এই চোখের জলটুকু আমার হাতের মার্বেল হ’য়ে আটলান্টিকে পড়েই হারিয়ে যাবে। কিছুই আর তোমাকে দেওয়া হ’বে না। দ্যাখো সমুদ্র কত বড়!”
রাত হ’য়ে গেছে, পক্ষীরাজ এসে থেমেছে ক্যাফেটোরিয়ায়। ভ্যান গগের ঘন নীল আকাশে লন্ঠনের উজ্জ্বল আলো হলুদ তারা হ’য়ে ফুটে উঠছে। পেভমেন্টের পাথরগুলোতে সে আলো ঠিকরে পড়ে গোলাপি-বেগুনি মত এক কোমল আভা ছড়াচ্ছে। রাতের ছবি, অথচ কোথাও কোনও কালো নেই। একটা রাস্তা কারো সাথে কথা বলতে না পেরে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে…সবুজ গাছ, একলা পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। নীল-বেগুনি, সালফার-হলুদ, সবুজ, আর ঝলমলে কমলা এ রাত। আমি সিসিডিতে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। হয়ত তুমি এসেও পড়তে পারো। কে বলতে পারে। মানুষের জীবনটা তো শুধু এমন কোন শিল্পনগরীতে বসে একের পর এক অ্যাবস্ট্রাক্ট সবুজ স্বপ্ন দেখে যাওয়া। কেবল তাই।
…… ‘পৃথিবী ঘুরে ঘুরে সামনে শেষ পথ…বেদুইন তাঁবু। জিপসি সুর নয়–সিম্বল, ক্ল্যারিনেট, চেলো বাজিয়ে কারা কারা সব অর্কেস্ট্রা বুনে যাচ্ছে… তুমি এলে না… দেওয়ালহীন আকাশ…হেলান দিতেই মরুভূমিতে বৃষ্টি নামল… থই থই করে উঠল বালু। সব জল ক্যাকটাসগুলো শুষে খেল। আর ভোরের শেষ তারাটা চিনতে গিয়ে আমি শুধু দেখলাম তারাতে তারা ঠুকে তারার ভিতর কেমন করে যেন আগুন জ্বলে উঠল”। অতঃপর ক্লান্তি এল।অতঃপর তুমি এলে…’ আমি অরণ্যকে ধরে ঝাঁকিয়ে দিলাম এরপর। নাহ এভাবে কখনই দেখিনি তাকে। মনে হল যেন চাঁদ থেকে নেমে এসেছে এক দিব্য পুরুষ। অপলক চেয়ে আছি তাঁর দিকে। তাঁর ঠোঁট নড়ছে শুধু। কিন্তু কোনো কথা শুনতে পাচ্ছি না আমি।
এরপর আমাকে জড়িয়ে সে একটা আলতো চুমু এঁকে দিল কপালে। তারপর আমার হাতের মুঠোয় তার হাত ভরে নিয়ে, চোখে চোখ রেখে অরণ্য বলল- যদি কখনও হারিয়ে যাই, আমি থাকব তোমার পাশে। এভাবেই। জানি না তার চোখে কি ছিল সেদিন। মোহিত হয়ে শুধু চেয়ে ছিলাম তাঁর দিকে। অনেকক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর আমরা হাঁটতে থাকি রাস্তা দিয়ে। আমাদের পাশ কাটিয়ে ফিরছিল ট্রাকের সারি। হেডলাইটের আলোয় জ্যোৎস্না তখন ম্লান। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে একটা ট্রাক আমাদের সামনে এসে হর্ণ দেয়। আর আমরা ব্যালান্স হারিয়ে নীচে পাহাড়ের গহীনে। তারপর…
তারপর আর কিছু মনে নেই। আমি কোথায়, অরণ্যই বা কোথায়। জ্ঞান ফিরল টানা ১৮ দিন পর। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। আমার জ্ঞান ফিরতেই অরণ্যের খোজ করি, সে কোথায়। কিছু হয়নি তো। আমার পাশে তখন বাড়ির সবাই। চোখ ভেজা। মা বলল অরণ্যের কিছু হয় নি। তুই সুস্থ হয়ে যা। তারপর তার কাছে যাবি। আমি ক্রমাগত অস্থির। অরণ্যের কাছে যাব বলে কাঁদছি। মা আর থাকতে না পেরে বলেই ফেলল, অরণ্যের পায়ে গভীর চোট। তাই অপারেশন করতে হয়েছে। তুই ভাবিস না। ও ঠিক আছে।
হসপিটাল থেকে ফিরে এসেছিলাম প্রায় দু মাস পর। শুধু অরণ্য বেঁচে আছে এই আশা নিয়ে। নাহ তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি একদিনের জন্যেও। সেও আসেনি দেখা করতে। খানিকটা অভিমানে আমি চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। কারো সঙ্গেই কথা বলিনি। বাড়ি ফিরেই যে চমকটা আমার জন্যে ছিল। সেটা আরও মারাত্মক। এসবের জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। এঁকে তো কি করে শিমলা থেকে ফিরলাম, কে তুলে এনেছিল। অরণ্যই বা কোথায়। কিছু জানি না। কিছু মাথায়ও ঢুকছে না। তার মধ্যে বাড়ির সবার মুখের হাসিটা যেন জোর করে আনা। দেখে বুঝতে পারছিলাম আমি। আমাকে ধরে ধরে নিয়ে এসেছিল আমার শাশুড়ি মা। ঘরে ঢুকেই দেখি একটা হুইল চেয়ারে বসে আছে অরণ্য আর তাঁর বাঁ চোখে তখনো একটা ব্যান্ডেজ। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ছুটে তাঁর কাছে যেতে চাইলাম। কিন্তু যেহেতু শরীরে জোর নেই খুব একটা। তাই যেতে গিয়েই পড়ে গেলাম। অরণ্য কাঁদছে। চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। তাকে জড়িয়ে আমিও আর আটকে রাখতে পারিনি। এতদিনকার অভিমান, না দেখতে পাওয়া। তাঁর চেয়ে বড়ো কথা। তাঁর বেঁচে থাকা। হসপিটালের বেডে শুয়ে কি না কি ভেবেছি।
৩
সেরে উঠতে এক বছর লেগেছিল দুজনেরই। অরণ্য পুরোপুরি হুইল চেয়ার নির্ভর আর আমি এক হাতে ফ্র্যাকচার নিয়ে বেঁচে আছি। দুজনেই কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম। ওর মা বাবা কেউ সেভাবে কথা বলত না আমার সঙ্গে। অনেকদিন বাদে অফিসে জয়েন করে নিজেকে একটু ভালো রাখার চেষ্টা করছিলাম তখন। আর অরণ্য চাইত আমি ঘরেই থাকি সারাক্ষন তাঁর সঙ্গে। আর কাউকে নয় সে আমাকে আঁকড়ে থাকত। আমিই যেন তাঁর খেলার সঙ্গী। তাঁর ব্যবহার হয়ে গিয়েছিল বাচ্চাদের মতো। আমি অফিসে থাকতাম, আর সে ফোনের পর ফোন করত আমাকে। তাঁর ফোনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যেত কলিগরাও। আমি অফিস ছুটির পর ছুটে আসতাম তাঁর কাছে। আমাকে ছাড়া সে খাবে না পর্যন্ত। শুধুমাত্র সন্তানের সঙ্গে যা সম্পর্ক, এই একবছরে আমাদের সম্পর্কটা তাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এমন না যে আমাদের শরীর জাগত না। কিন্তু সেই দুর্ঘটনার পর অরণ্যের মেল পার্ট প্রায় আর কোনো সাড়া দিত না। তবু চেষ্টা করতাম, যতটা তাকে খুশী রাখা যায়। রাতের পর রাত সে শুধু আমাকে জড়িয়ে থাকত। স্তনে মুখ রাখত। এই তাঁর খেলা। আমিও তাঁর খেলায় যোগ দিতাম। শুধু তাঁর খুশীর জন্যে নয়। তাকে ভালোবাসতাম বলেই।
এভাবেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ত সে, আর আমি সারা রাত অস্থিরতায় কাটিয়ে দিতাম। সকাল হলে তাকে খাইয়ে দিয়ে তবেই আমি বেরিয়ে পড়তাম অফিসের জন্যে।
৪
এভাবেই দিনগুলো কাটছিল। অরণ্য ক্রমাগত নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিল। সে আর আঁকে না। লেখে না। শুধু চেয়ে থাকে কখন আমি আসব। অনেক ডক্টর দেখানো হয়েছিল তার জন্যে। তাকে মেন্টাল অ্যাসাইলামে পর্যন্ত নিয়ে যেতে বলেছিল অরণ্যের আত্মীয়েরা। কিন্তু আমি নিয়ে যেতে দিইনি।
অনেক রাতে একবার ভীষণ বৃষ্টি নেমেছিলো। আমার এত একা লাগছিলো। তাই চলে গিয়েছিলাম ছাদে। আর বৃষ্টিও এমন জোরে হ’চ্ছিল যে আশেপাশের বাড়ির সব মানুষ দরজা, জানালা বন্ধ করে ঘরের ভেতর ছিল। পা টিপে, টিপে আমি সেই গভীর রাতের বৃষ্টি ছুঁয়ে ফেলব বলে একা একা ছাদে গিয়েছিলাম। বৃষ্টি ছাড়া আমার শরীরে সেদিন আর কোনও রেশমি সূতোই ছিল না। চিৎকার করে বলছিলাম শরীরের সমস্ত ভালোবাসাটুকুও তোমার জন্য অরণ্য। এইখানে, এই বুকের ভেতর। যেহেতু আমাদের রুমটা ছিল দোতলায়। অরণ্যকে অনেকসময় ছাদে নিয়ে আসতাম আমি। ওপরে আসার জন্যে স্লাইডিং সিঁড়ি একরকম জোর করে বানিয়ে নিয়েছিলাম। হুইল চেয়ার ঠেলে ঠেলে অরণ্যও উপরে উঠে এসেছিল কখন জানি না। সে শেডের মধ্যে বসে বসে আমাকে দেখছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, তাঁর অসহায়তা, তাঁর কান্না। কিন্তু কিছু করার ছিল না। আমিও নিজের কান্না আটকানোর জন্যে বৃষ্টিকেই আশ্রয় করে নিয়েছি। অরণ্য ছোট্ট বাচ্চার মতো হাততালি দিচ্ছিল, আর হাটবার জন্যে পা বাড়িয়ে দিচ্ছিল। যেহেতু অ্যাক্সিডেন্টে তাঁর কোমরের থেকে নীচের দিক অসাড় হয়ে গিয়েছিল। এক বছরের বাচ্চাও এরকম হাঁটতে চাইলে পারে না। কিন্তু অরণ্য তো ২৮ বছরের একটা তরতাজা যুবক। সেইমুহুর্তে হাঁটতে চাওয়াটা ফ্যান্টাসি তাঁর কাছে। তাঁর এই অবস্থা দেখে আমারো মনে হল, ঝিমিয়ে, ঝিমিয়ে পুরোটা জীবনই কাটিয়ে ফেলছি আমরা। হাতদু’টো দিয়ে হাঁটু চেপে ধরে, হাঁটুর ভিতর মাথা গুঁজে বসে বসে কাঁদছি শুধু। আর কেবলই ভাবছি যে হয়তো কোনও একদিন এত জোরে বৃষ্টি নামবে যে কোথাও আর যাওয়া যাবে না। বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে তুমি ছেলেবেলার গল্প বলবে– যে গল্প কোনদিন কাউকে বলোনি। হেঁটে চলে বেড়াবে। খুনসুটি করবে। হয়তো পরের জীবনের গল্প বলবে – যে গল্প তুমি নিজেও জানো না। কত গল্প গাছের শরীরে… সেই সব গল্পগুলো বলবে আর হাসবে।
কিন্তু নাহ, অরণ্য উঠে দাঁড়াত না তাঁর হুইল চেয়ার থেকে। আমার সমস্ত চেষ্টা ব্যার্থ হতে লাগল পর পর।
৫
এদিকে মা বাবা অস্থির। কতদিন আর মেয়ে এভাবে একজন অচল মানুষকে নিয়ে জীবন কাটাবে। আমার দিকে তাকাতে পারত না। আমিও তাঁদের পারতপক্ষে এড়িয়ে চলতাম। কারন তাঁদের কাছে গেলেই সেই এক কথা। অরণ্যকে ছেড়ে নতুন জীবন গড়ে নিতে হবে। আর আমি, যতদিন যাচ্ছিল ক্রমশ অরণ্যকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছিলাম। সে ছিল আমার সন্তানের মতো। যেদিন অফিস থেকে ফিরতে দেরী হত অরণ্য হাতের কাছে যা পেত ছুঁড়ে ফেলত। আমাকে চোখের আড়াল করতে চাইত না। আমিও বুঝে উঠতে পারিনি কেন সে এতটা অবসেসিভ হয়ে গিয়েছিল আমার জন্যে। নাহ সে সুযোগ পাইনি। প্রশ্ন করার আগে অরণ্য সেদিন এমন বিহেভিয়ার করেছিল। আর মা বাবা সেদিনই দেখতে এসেছিল আমি কেমন আছি। প্রতি মাসেই তাঁরা আসত আমাকে বোঝাতে। আর সেইদিনটা যে কি দিন যেত আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না।
রবিবার দুপুরে অরণ্যকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া পর্যন্ত আমার কোনো স্থিরতা থাকত না। আমিও তাকে খাইয়ে ঘুম পাড়ানোর জন্যে মন অন্য দিকে দিতাম না। অরণ্যের মা বাবা এই সময় থাকেন না। তাঁরা তো প্রায় আসেন না আমাদের ঘরের দিকে। নিজের ছেলের প্রতি এই ব্যবহার আমার ভালো লাগেনি কোনোদিন। অরণ্য সকাল থেকেই অন্যরকম ব্যবহার করছিল আমার সঙ্গে। খাওয়ানোর সময় সেদিন অপছন্দের খাওয়া নিয়ে সে ঘ্যান ঘ্যান করছে। খাবার খেতে চাচ্ছিল না। ফেলে দিচ্ছিল। আমার হাত থেকে বাটি নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল মেঝেয়। তারপর আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দেয়, যার জোরে আমি ড্রেসিঙয়ের সামনে গিয়ে পড়ি, আমার মাথায় আঘাত লাগে। আমি সেন্সলেস হয়ে যাই।
৬
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। মা, বাবা আমাকে নিয়ে চলে যান লন্ডনে দাদার কাছে জোর জবরদস্তি করে। আমি অনেকবার পালিয়ে আসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। হয় মা, না হয় দাদা ঠিক দেখে ফেলত। আটকে দিত। আমার পাসপোর্ট লুকিয়ে রেখেছিল।
আমি একা একা ঘুরে বেড়াতাম, চেরি গাছের কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতাম। পায়ের কাছের নরম সবুজ ঘাসে চেরি গাছের ফুল ঝরে পড়ত আর আমি ভাবতাম অরণ্যের কথা।
একদিন বরফের ওপর হাঁটতে গিয়ে লাল রঙের ‘হারভেস্ট মুন’ আমার শরীরের চামড়া ছুঁয়ে ফেলেছিলো। সে আলো আমি পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখি নি। আমার আকাশ জুড়ে সারা রাত কত যে অরোরা জ্বলেছিলো। আমি তাকিয়ে, তাকিয়ে দেখছিলাম সে বেগুনি রঙ কীভাবে কাঁপতে, কাঁপতে হাত পা অবশ করে দিতে পারে। কীভাবে তার চোখ আমাকে বরফ করে দিতে পারে। এতগুলো বছর পরও অরণ্য ঘুরত আমার চারদিকে। সেদিনের সেই রাতের কথা ভুলে যেতে পারিনি কোনওদিন। মা বাবা বিয়ের চেষ্টা করেছিল অনেকবার। প্রতিবারই আমি নিজে ভেঙ্গে দিয়েছি কিছু একটা করে। এতটা অসহায় মনে হয়নি আগে কখনো। শরীরও ঠিক থাকত না। ক্রমশ রুগ্ন হয়ে পড়েছিলাম।
আমি জানতাম, যে পুরো শরীর দিয়ে কোনোদিনই তোমাকে পাব না। তোমাকে কোনোদিন দেখতে পাবো এই আশাই ছিল না। এ আমার শরীর। যেন এক পাথর। পেরেক গাঁথতে গেলে পেরেকই বেঁকে যাবে। এখন যদি আঁকড়ে ধরতে যাই, তোমার শরীর চিরে গিয়ে রক্ত বের হবে। তবে এসো, শুধু আঙুলের এই একদম সামনের ডগাটুকু দিয়েই না হয় তোমাকে একটু ছুঁই। মানুষ যেভাবে মেঘ ছোঁয়। বৃষ্টি ছোঁয়।
অরণ্যকে ভেবেই বলতাম। ‘ কাল পথের পাশের মরা ওক গাছটায় একটা সোনালি রঙের ঈগল দেখেছিলাম। কি অসম্ভব রাজকীয়। পেটের নিচটায় নরম বাদামি তূলোর মতো, পালকে ঢাকা হলদে পা। ভাবছিলাম ওকে বলি ওর পাখায় করে আমাকে একটু তোমার কাছে নিয়ে যেতে’।
ভীষণ ঝড় হচ্ছে এখন। এই ঝড়ে তোমার চুল এলোমেলো হ’য়ে তোমার চোখে এসে পড়ছে। তুমি তো কিছু দেখতেই পাচ্ছ না। আমার ইচ্ছে করে তোমার চোখের উপর থেকে শুধু ওই চুলগুলো একটু আলতো করে সরিয়ে দিতে। আর তো কিছু না…
‘আচ্ছা, তুমি কি সেই প্রাচীন ব্লু-বনেটের লোকগাথাটা জানো? সেই সে একাকী মেয়ের গল্প? প্রত্যেক বসন্তে গান করত আর ঘুরে, ঘুরে নাচত। বৃষ্টি নামত তাতে। কিন্তু একবার সব বৃষ্টি থেমে গেল। জল না পেয়ে মানুষগুলো মরে গেল। আগুনের ভিতর প্রাণের পুতুল ছুঁড়ে দিল মেয়ে। পুতুলের মাথার নীল পালক আগুনে পুড়ে, পুড়ে পরদিন ভোরে সারা পাহাড় জুড়ে ব্লু-বনেট হ’য়ে ফুটে উঠল। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামল।‘
আমারো ইচ্ছে করে ঠিক এরকম করেই নিজেকে তোমার দিকে ছুঁড়ে দিতে…
৭
অরণ্য তারপর অনেক চিঠি লিখেছিল আমাকে। কিন্তু মা কোনোদিনই সেই চিঠি আমাকে দেয় নি। লুকিয়ে রাখত। এই সেদিন যখন অরণ্যের শেষ চিঠি এলো, সেদিনই শুধু মা চিঠিটা হাতে ধরিয়ে বলেছিল একবার অরণ্যের কাছে যেতে। সঙ্গে ধরিয়ে দিয়েছিল ৭০ ডলার আর লুকিয়ে রাখা পাসপোর্টটা। চিঠিতে শুধু একটা ঠিকানা আর লেখা
প্রিয় অদৃ,
‘ফিরে এসো শেষবারের মতো ‘
তোমার অরণ্য
আর দেরী না করেই তাই ছুটে এসেছে। কিন্তু এখনো অরণ্য এলো না কেন। তাঁরা যে আর পুরনো ঠিকানায় নেই সেটা মা বলে দিয়েছিল। তাই অরণ্যের দেওয়া এই ঠিকানায় এসে বসে অদৃজা। লেকটা খুব সুন্দর। বাংলায় এরকম একটা সুন্দর লেক আছে। যার পাশে গাছ-গাছালি, পাখি। পথ চলতি মানুষেরা এখানে এসে খানিক বসে থাকে। তারপর আবার চলে যায়। লেকের জলে সূর্যের আলো, সন্ধে হয়নি এখনো। আমার মনে হচ্ছে কোনো পরজন্ম নেই। পূর্বজন্ম নেই। শুধু হাতের মুঠোয় এই এখনকার এইটুকু সময়– সবুজ মার্বেলের মতো। কাচের ভিতর বন্দী এ কারো চোখের জল। এক ফোঁটা জল। হতে পারে আমার, হতে পারে অরণ্যের।
দূরে কোথাও গিটার বাজছে। পৃথিবীতে সন্ধে হচ্ছে। অপেক্ষার রঙ বদলে গিয়ে এত বেশি উজ্জ্বল হয় যে সব রাজকন্যারা পথ ভুলে যায়। অদৃজা শুধু তাকিয়ে থাকে–পলক পড়ে না চোখের। লেকের জল রঙ বদল করে। তাঁর পাশে বেঞ্চে তখনও শূন্যতা। বহুদিন আগে এই ছায়ার ভেতর অরণ্য হেঁটে গিয়েছিল মন চুরী করে। দূরে লাইটগুলো জ্বলে উঠতেই ঝলমলে চারদিক কেমন খুশী খুশী গন্ধ। হ্যাঁ ছোটো থেকে আলো জ্বলে ওঠাকে খুশীর গন্ধ বলতাম আমি। একটা ছায়া হেঁটে আসছে অনেকদূর থেকে। ক্রমশ ছায়াটা ঘন হতে হতে অদৃজার পাশে এসে থেমে যায়। অদৃজা চোখ তুলে তাকাতেই দেখল অরণ্য… সেইমুহুর্তেই দূরে কোথাও পটকা, বাজি, হাউই উড়তে শুরু করল… ফেলে আসা হাজার বন্ধ দরজাগুলো এক এক করে খুলে যেতে লাগল। আগামীর রাতের ফুলঝুরিগুলো জ্বলতে থাকল অন্য কোনও রাতে। অন্য কোথাও, অন্য জীবনের ভিতর… অদৃজা.. অরণ্য হাঁটতে থাকে হাতে হাত রেখে।এবার দীর্ঘ স্বপ্ন দেখার দিন।
ছবি এবং ইলাস্ট্রেশন- গুগল