নারায়ণী একা একা খিস্তি দেয়। খিস্তি দেওয়ার সময় সে জলের কলটা খুলে নেয়। ছর ছর ছর করে এক টানা জল পড়ে। জল পড়ে পাতা নড়ে!
নারায়ণী সারাদিনে চোদ্দটা বাড়িতে কাজ করে। আর একটা মেসে। সেটা চারটে বাড়ির সমান। যে রান্না করে হারামজাদি বুড়ি মাগিটা সে খুব বজ্জাত। বাসনগুলো এমনভাবে পোড়ায়, ঘষতে ঘষতে নারায়ণীর ড্যানা খুলে যাওয়ার জোগাড়। ওই বুড়িটা ইচ্ছে করেই বাসনগুলোর ওই দশা করে। কেন-না এই ঠিকে কাজটা ওর বোনঝিকে পাইয়ে দিতে চায় বুড়িটা। কিন্তু বাড়িওলা ওই বুড়ির স্বামী ছাড়া মেয়েকে মেসে ঢোকাবে না। মেয়েটার চোখ-মুখ নাকি কথা কয়। নারায়ণী মেয়েটাকে দেখেছে, ওর চোখ মুখ কথা কয় না, কথা কয় ওর গা-গতর, শরীর! বছরখানেক ওর স্বামী ওকে ছেড়েছে। ও মেয়ে বাঘিনির সমান। ও একদিন এসে নারায়ণীকে দুঃখের কথা বলতে চেয়েছিল। বলতে চেয়েছিল, মেসের কাজটা যদি নারায়ণী ওকে দেয়, তবে মাসি-বোনঝি মিলে ওরা কাজ করে এখানে।
ওর সঙ্গে কথা বলেনি নারায়ণী। কথা বলেছে বাড়িওয়ালা। খুব হালকা করে বলে দিয়েছে, যে কাজ করে তাঁকে কী করে ছাড়ব। সে কামাই করে না, তার কোনও ফল্ট নেই। আমার মাথায় থাকল। যদি দরকার পড়ে তোমার মাসিকে দিয়ে খবর করব।
নারায়ণী জানে কক্ষনও বাড়িওয়ালা খবর করবে না। খাল কেটে কে কুমির ঢোকায়? মেসে পাঁচঘরের ছেলেপুলে থাকে, তাঁদের এক-একটার মতিগতি এক একরকম। ঐ রকম টাটকা একটা মেয়েমানুষ দেখলে না জানি কার না কার নোলা সকসক করে! তারপর দিল একদিন হাত ধরে টান মেরে, কিংবা সুযোগ-সুবিধে পেলে, আর মেয়েটার যদি কুটকুটি ওঠে তাহলে তো কাণ্ড সেরেছে। তখন থানা পুলিশ টিভি। বাড়িওয়ালার হাতে হ্যারিকেন! এমনিতে এই মেস নিয়ে পাড়ার লোকের খুব আপত্তি। বাড়িওয়ালা ক্লাবকে হাত করে এই মেস খুলে রেখেছে। নইলে কবে উঠে যেত। ক্লাবের কথামতো বুড়িকে রান্নার কাজও দিয়েছে। নইলে ওই বুড়ি কি রান্না করতে পারে- যা কিছু করে সব জলসা। কোনও টেস্ট নেই। আলু, ডিম সব কেমন সাদা ফ্যাটফেটে মেরে জলের তলায় সেঁধিয়ে থাকে। গামছা পরে নামলেই ডুব দিয়ে চান সারা যাবে। বুড়িকে রান্নার কথা বললেই বলবে- যেমন তেল-মশলা তেমন রান্না! বাড়িওয়ালাকে সে কথা জানালে সে রান্না ঘরে গিয়ে লঙ্কা-হলুদের দুটো প্যাকেট এনে নাকের সামনে নাড়িয়ে দেবে। বলবে সব আছে। কিন্তু তোমাদের পেটটাও তো দেখতে হবে। এই খেয়ে সুস্থ থাকছ। জিব বড় শত্তুর। ওকে আশকারা দিয়ো না। নারায়ণী এসব কথা কানে তুলো দিয়ে শোনে। আর মনে মনে হাসে। মাঝে চারদিন বুড়ি আসছিল না। নারায়ণী মেসে রান্না করে দিয়েছিল, সবাই হাত চেটে খেল। সে কথা বুড়ি ফিরেই জেনেছে। আর সেই জানা থেকে এমন করে বাসন পোড়ায়। ভাতের হাঁড়িতে জল না দিয়ে শুকনো করে রাখে। নারায়ণীকে ওই বুড়ি হারামজাদি উচ্ছেদ করতে চায়। আর সে নারায়ণী- তাঁকে উচ্ছেদ করা অত সহজ নয়।
কতজনই না নারায়ণীকে সারাজীবন ধরে উচ্ছেদ করতে চাইল, পারল?
এসব কারণে নারায়ণী কলের জল খুলে খিস্তি দেয়। কলের জল খুললে তার সব খিস্তি চাপা পড়ে যায়। জলের ছরছর আওয়াজের ভেতর খিস্তিগুলো নারায়ণীর মুখ থেকে পড়ে, আর পড়েই হারিয়ে যায়। কোনও কোনওটা স্বয়ং নারায়ণীর কান পর্যন্ত যায় না।
খিস্তিগুলো যেন রাগে রাগে বলা। আর রাগে রাগেই ধুয়ে দেওয়া। চোদ্দো বাড়ির কাজ তার, মুখ যদি সচল না থাকে নারায়ণীকে ওই বাসনমাজার ঘোলা জলের ভেতর ধুয়ে যেতে হত। ছাই আর ডিটারজেন্টের সঙ্গে, শালপাতা আর স্ক্রাবারের সঙ্গে তলিয়ে যেতে হত। একা একা এত খিস্তি দিয়ে নারায়ণীর মুখে কোনও কালো কালো ছোপ পড়ে না। কেন পড়বে? এত এত জল ঘেঁটে যদি তার হাতে না হাজা হয়, তবে মুখে কেন দাগ হবে?
নারায়ণী এই কথা শিখেছে দেবলীনা বউদির কাছ থেকে। দেবলীনা বউদি সিঁদুর পরে না। একবার পুজোর সময় নারায়ণী সেই বউদিকে বলেছিল, ও বউদি তুমি সিঁদুর পড় না কেন গো? তোমাকে সিঁদুর পরলে কত ভাল দেখাত। দেবলীনা বউদি হেসে বলেছিল, ‘আমি তো লিপস্টিকও দিই না, সেটা বলো না কেন? লিপস্টিক দিলে তো আমাকে আরও ভাল লাগত’।
কথাটা নারায়ণীর খুব মনে ধরেছে।
তবে নারায়ণী মাঝে মাঝে রাতে দু’হাতে তেঁতুল মাখিয়ে রাখে।
পুরোনো কালো তেঁতুল। যত কীট, পোকা-টোকা গন্ধে নাশ হয়ে যাবে। সেই আগে প্রথম যখন কাজে লেগেছিল চম্পার মা তাঁকে এটা শিখিয়েছিল। এখনও সে তাই করে।
আর কেলোর মা তাঁকে বলেছিল, ‘মুখ চালু রাখবি রে মেয়ে, নইলে গতরে সব পোকা ধরিয়ে দেবে’।
সে তেমন করে মুখ খুলতে পারে না। সে তার মতো করে হাতের ব্যবস্থা করেছে। বাসন যদি বেশি পড়ে তবে মাজার সময় জোরে আওয়াজ করো। মেঝেতে বাসন ঠোকো। বাসনে বাসন ঠোকো। যে বোঝার সে বুঝে যাবে- আজ বাসন বেশি পড়েছে। চোদ্দো বাড়ির কাজ করতে করতে সে সতেরো রকম লোক দেখেছে। দেখেছে সতেরো রকম লোকের সত্তর রাগ। অথচ সবাই মুখটি বন্ধ করে আছে। নারায়ণী বোঝার চেষ্টা করে। ওরা মুখ বন্ধ করে আছে। নারায়ণী বোঝার চেষ্টা করে। ওরা মুখ বন্ধ করে থাকে কীভাবে? তখন তার মাথায় ঝিলিক মারে, ওরা হয়তো তারই মতো বাথরুমে ঢুকে কলের জল খুলে তেড়ে খিস্তি দেয়। ফুর্তিতে থাকলে মানুষজন গান গাইবে। বাথরুমে ঢুকলেই টেরটি পাওয়া যায়। ফুরফুর করে কেমন গান বের হয়। আর রেগে থাকলে-। আসলে গান জিনিসটা শোনানো যায়, খিস্তি শোনানো যায় না। নারায়ণী বোঝে কলঘরটা শুধু শরীরের ময়লা পরিষ্কার করার জায়গা নয়, মন পরিষ্কার করারও জায়গা।
আবার নারায়ণী একজনকে দেখেছে, বাথরুমে ঢুকত কাঁদতে। বাথরুমের মধ্যে কে কী করছে তাও কেউ-ই বুঝতে পারে না। কিন্তু এক্ষেত্রে সে পারত। ওই যে খবরের কাগজে ছবি দিয়ে দেখায় না, অপারেশনের আগে এই ছিল, অপারেশনের পরে এই হইয়াছে। জালার মতো ভুঁড়ি ছিল- নেড়ি কুত্তার মতো পেট হইয়াছে। ছোট বুক বড় হইয়াছে, বড় বুক শেপে আসিয়াছে।
বউটি যখন বাথরুমে ঢুকত, মুখটা ফেটে যাওয়ার মতো টসটসে লাল হয়ে থাকত। বাথরুমে ঢুকে ওর যেন রক্তপাত হত। মুখটা সাদা হয়ে ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে ফিরত। যেন সব দুঃখ, সব কষ্ট ধুয়ে দিয়ে আসত বাথরুমে। নারায়ণী বুঝত এ বউ মরবে। কষ্টে দগ্ধে মরবে। বাথরুমেই গায়ে আগুন দিয়েছিল বউটি। স্বামী আর শাশুড়িটাকে জেল খাটিয়েছিল কতদিন।
কিন্তু আর সবার সঙ্গে নারায়ণীর একটু তফাৎ আছে। কলঘরটা তার কাজেরও জায়গা। সে তো আর চেয়ারে বসে টেবিলে কম্পিউটার খুলে বাসন মাজতে পারবে না।
নারায়ণী কাজ করতে করতে খিস্তি দিতে পারে, অদৃষ্টকে দোষ দিতে পারে। আর অদৃষ্টকে দোষ দিলে সবার আগেই নিজেকে খিস্তি দিতে হয়, তাও দেয়, কিন্তু কোনওদিন ভগবানকে খিস্তি দেয় না। আর নিজের কাজকে ছোট করে না। যতটা পারে কাজ করে দেয়, ফাঁকি দেয় না সে।
সেটা কাজ বলো আর সংসার বলো।
তার নিজের সংসারের গপ্প নারায়ণী বড় একটা করে না। তার কারণ আছে, বেশিরভাগ বউদিরা কাজের লোকের সুখের গপ্প সইতে পারে না। যদি তুমি একবার সুখের গল্প করে রাখো, আর কোনওদিন সামান্যটুকু দুঃখের গপ্প কোরো, ব্যস তোমাকে মুখের ওপর কত কথা শোনাবে। যেন যে স্বামী সোহাগ করে তার সঙ্গে একটু ঠোকাঠুকি হতে পারে না! ওদের যে বাইরে স্বামী-স্ত্রীর কত ঢলানি হচ্ছে, আর রাতেরবেলা দরজা বন্ধ করে চুলোচুলি করছে তার বেলায় কিছু না! সকালবেলা ঘর ঝাঁট দেওয়ার সময় নারায়ণী সব টের পায়। আর স্বামীগুলো বেরিয়ে গেলে বউগুলো যখন ফোন করে একে তাকে বাপের বাড়ি, বন্ধুদের সে সব কথাগুলো গলগল করে উগরায়, নারায়ণীর তখন বলতে ইচ্ছে করে, বোকা মেয়ে! যা যা বাথরুমে গিয়ে কল খুলে আচ্চা সে খিস্তি দে।
তবে নারায়ণীর খুব সন্দেহ অনেক মেয়েই ঝগড়া করতে পারে, জিনিসপত্তর ছোড়াছুঁড়ি করতে পারে, দরকারে নখ বাগিয়ে গিয়ে ঘ্যাঁক করে কামড়ে দেয়, কিন্তু ঠিক খিস্তি বস্তুটা জানে না। তাই তাঁদের এত রোগভোগ। বাথরুমে গিয়ে যদি মন হালকা করে খিস্তি দিতে পারত শরীরও হালকা হয়ে যেত।
একটা সিনেমায় সে দেখেছিল হিরো হিরোইনের কানে ফোন ধরিয়ে দিয়েছে। দিয়ে বলছে খিস্তি দে, খিস্তি দে, খিস্তি দিলে মন ভাল হয়ে যাবে। টিভিতে সিনেমাটা দেখতে দেখতে সে হেসেছিল। সে কবেই এসব ভেবেছে, আর এত পয়সাওয়ালা লেখাপড়া করা সিনেমাওয়ালারা আজ ভাবছে।
তবে হ্যাঁ, সে তো গো মুখ্যু নয়। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছে। পাশ করে এইটেও উঠেছিল। যদি ড্যামের জলে ভেসে ভেসে তাঁদের গ্রাম না উচ্ছেদ হত তাহলে সে হয়তো ক্লাস টেনটাও দিয়ে দিত। তবে সেভেন পর্যন্ত সে যা পড়েছে সব মনে আছে। সে ফাঁকি দেয়নি। তাই সে কাজের সময় জিজ্ঞেস করে নেয়- কোথায় বসে বাসন মাজতে হবে?
সবাই চায় রান্নাঘরের সিঙ্কে কাজ সারাতে। নারায়ণী তাঁদের সাফ বলে দেয় কাঁচের জিনিস, পাথরের জিনিস, কাপ, প্লেট, কাঁটা চামচ সব সে সিঙ্কে মেজে দেবে। কিন্তু হাঁড়ি, প্রেশার কুকার, সসপ্যান-যা পুড়বে তা আপনাদের ওই সিঙ্কে হবে না। হলে পোড়া হলুদ, হলুদ দাগ থাকবে, আমাকে বলতে পারবেন না। পোড়া হলুদ দাগ তুলতে হলে আমাকে একটা পিঁড়ি দিতে হবে। বাসন ঝকঝকে পাবেন। আর হ্যাঁ, বাসন মাজার ভাল সাবান দেবেন, লিক্যুইড সাবান হলে বাসনের জেল্লা বাড়ে। এবার আপনাদের ব্যাপার।
নারায়ণীকে যারা একবার পেয়েছে তারা ছাড়তে চায় না। কাজ পরিষ্কার। কামাই নেই। ছুটি নিলে আগেভাগে বলে দেয়। আর কোনও চুরিচামারি নেই। মাথায় বেশ বুদ্ধি রাখে। অহেতুক কৌতূহল দেখায় না। কোনও গোপন বস্তু দেখলে নিজের বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী ঘটনাটা বিশ্লেষণ করে। এই যেমন, মাঝেমাঝে সকালের কাজে এসে সোমা বউদির বেডরুমে খাটের পায়ার কাছে একটা ছোট্ট তোয়ালে পাওয়া যায়। আপাতভাবে সেটি খুব নিরীহ একটা বস্তু। কিন্তু নারায়ণী সেটা পারতপক্ষে টাচ করে না। বোঝে এটি গোপন বস্তু। সে ওটাকে পাশ কাটিয়ে ঝাঁট দেয়, ঘর মোছে। কোনওদিন সোমা বউদি নিজেই ওটা সরিয়ে নিয়ে যায়। কোনওদিন পড়ে থাকে। পড়ে আছে বলে কেউ কোনও অভিযোগ করে না, বা কথা শোনায় না। অন্য কোনও জিনিস এমন মিস করে গেলে সোমা বউদি কম কথা শোনাত না। এই থেকে নারায়ণী সিদ্ধান্তে এসেছে- বস্তুটি গোপন। তার নজর করার দরকার নেই।
কিন্তু একদিন বেটাইমে বস্তুটিকে নারায়ণী আবিষ্কার করল খাটের পায়ার কাছে। দেখল সিঙ্কে তোলা কাপ প্লেট পড়ে। বুঝল কেউ এসেছিল। কিন্তু ঘর ঝাঁট দিতে গিয়েই ও চমকে উঠল। খাটের পায়ার কাছে ছোট্ট তোয়ালেটা সকালে দেখেনি, বিকেলে দেখল।
যা বোঝার নারায়ণী বলল, ‘তুমি বড্ড বেখেয়ালি বউদি। অত দামি কাপ-প্লেট কেউ আমার হাতে ছাড়ে! তারপর খাটের তলায় রাতের তোয়ালেটাও পড়ে আছে’।
সোনা বউদি নারায়ণীকে খুব ভালোবাসে।
ওর খুব গুণ। হাতের কাছে, ঝাঁটার ডগায় যা দেখে ফেলে দেয় না। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত বিদ্যা, কিন্তু দরকারি কাগজ দেখলে এক নিমেষে বুঝতে পারে। প্রেমপত্র গোছের হলেও উলটোপালটা লোকের হাতে তুলে দিয়ে ন্যাকা সাজে না। বরং যার জিনিস তাকেই দেখাতে চায়। তবে এখন আর কেউ প্রেমপত্র লেখে না। সে ঝামেলাও চুকেছে। এটা কাজের প্রথম দিকে হত। এখন হয়ই না। তবে এখন প্রেমপত্র অন্যরকম হয়েছে। একদিন মানতাসা দিদির পড়ার টেবিলে ঝাঁটা গলিয়ে যেটা পেয়েছিলে, সেটাও একটা প্রেমপত্র। ওই যে আজকাল সব বেরিয়েছে না- যাই করো, যত হুদ্দুম কুস্তি করে এসে ২৪ ঘন্টার মধ্যে একটা ওষুধ খেয়ে নাও। তাহলে আর প্রেগনেন্ট হবে না। তার খালি প্যাকেট। প্যাকেট পেয়ে নারায়ণী আঙুল দিয়ে দেখেছিল, নেই। মানে টুয়েলভে পড়া এই মেয়ে খেয়েছে। নারায়ণী পারত প্যাকেটটা নিয়ে মেয়ের মায়ের হাতে দিতে, দেয়নি। বরং বারান্দায় কানে মোবাইলে থাকা দিদিকে ডেকে এনেছিল ঘরে। তারপর ওষুধের প্যাকেটটা দেখিয়ে বলেছিল এটা তোমার?
মানতাসা মোবাইল ছেড়ে ছোঁ মেরে ওষুধের প্যাকেটটা নিয়ে বলেছিল- এটা কাউকে দেখাওনি তো! নারায়ণী না হেসে বলেছিল, না। মানতাসা ওর গাল টিপে দিয়েছিল। আদর! নিজে খেয়েছে, সে খবর চাপা দেওয়ার জন্য ওকে করল। তারপর, চোখ পাকিয়ে বলল- এটা কি তুমি জানো?
নারায়ণী কোনও কিছুই না ভেবে বলে দিল, হ্যাঁ জানে। হাগুন্তির লজ্জা নেই দেখুন্তির লজ্জা!
মানতাসা বলল, কী করে জানো- তুমি খেয়েছ নাকি?
টিভিতে তো দেখি।
টিভিতে দেখো! এখানে পড়লে কী করে।
আমি পড়তে জানি।
বাব্বা! ইংরেজি পড়ে ফেললে!
শুধু নামটা।
গুড। তোমাকে আমি একটা জিনিস গিফট করব। নেক্সট উইকে।
নেক্সট উইকে মানতাসা নারায়ণীকে ওর পুরনো মোবাইলটা দিল। বলল, এটা তোমার, বরকে দিয়ে দেবে না।
মাঝেমাঝে মানতাসাদের বাড়ি এলে সে মোবাইলটা দেখে। বলে, ঠিকঠাক চলছে।
নারায়ণী হাসে। কিন্তু একদিন দেখল, সেই মানতাসা বিছানায় ডিগবাজি খেয়ে পড়ে আছে। নারায়ণী ভাবল, মেয়ে আবার আদর খেয়েছে আর সেই ওষুধ গিলেছে নির্ঘাত।
নারায়ণী আঁতিপাঁতি করে ঘর ঝাঁট দিল, না, কিচ্ছু পেল না। শেষে বিছানা ঝাড়ার সময় টপ করে বলল, ‘ওই ওষুধ আবার খেয়েছ নাকি- এমন করে পড়ে আছ?’
মানতাসা ভেজা চোখে বলল, ‘ব্রেকআপ!’
নারায়ণী বলল, ‘আপদ বিদেয় হয়েছে’।
মানতাসা অবাক, ‘তুমি ব্রেকআপ বলতেই বুঝে গেলে!’
‘না বোঝার কি আছে, সব টিভিতে দেখায়’।
নারায়ণী বলল, ‘কাটানছাড়ান হয়েছে বলে- তুমি কি পড়ে পড়ে কাঁদছ?’
‘না, কাঁদছি না। কিন্তু নিজেকে বুস্টআপও করতে পারছি না’।
নারায়ণী বলল, ‘তুমি ছাড়লে না, তোমাকে ছাড়ল?’
‘আমারই এক বন্ধুর সঙ্গে-।’
নারায়ণী বলল, ‘ও তোমাকে ঠকাল। দাও, ফোন করে খিস্তি দাও’।
‘হোয়াট!’
নারায়ণী বলল, ‘সিনেমায় দেখনি, করিনা কাপুর দিচ্ছিল। মা-মাসি তুলে খিস্তি দাও’।
‘না না আমি পারব না’।
‘তালে ঝেড়ে উঠতে পারবে না। হেদিয়ে থাকো’।
পরের দিন মানতাসা রাজি হয়ে গেল। ঘরের ঝুল ঝাড়ার নাম করে দরজা বন্ধ হল। তার আগে বেশ ডজনখানেক খিস্তি মানতাসাকে নারায়ণী রিহার্স করাল। তারপর ফোন ধরে শুরু হল- কিন্তু ওমা, মানতাসা খান চারেক দিয়েই বাস্টার্ড বাস্টার্ড করে আটকে গেল। নারায়ণী বুঝল, এ মেয়ের রেকর্ড আটকে গেছে। সে ঝপ করে ফোন কেড়ে নিয়ে ওই ছেলের বাপ-ঠাকুর্দার সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটেকুটে, ঘেঁটেমেটে এক করে দিল। কী খিস্তি কী খিস্তি! এমন ঘরে, নরম বিছানায় বসে সে খিস্তি দেয়নি এর আগে।
বিছানায় তখন হাঁ হয়ে বসে মানতাসা। নারায়ণী ফোন ছাড়তে বলল, ‘এগুলো সব আমার নামে মার্কেটে ছেড়ে দিলে’।
নারায়ণী বলল, ‘ওই ছেলে আর কোনওদিন তোমার দিকে মুখ তুলে তাকাবে না, যা ওষুধ দিয়েছি না! ওই না পোয়াতি হয়ে যায়’।
‘পোয়াতি!’ মানতাসা হেসে কুটোপুটি হয়, তবু বলে, ‘ও যদি গালাগালির কথা শুনে আমাকে ফোনে ডিসটার্ব করে!’
‘খিস্তি ওর বাপ ঠাকুর্দাকে দিয়েছি, ও কিছু বললে এবার ওর মা মাসি উদ্ধার করে দেব। এমন ধুয়ে দেব আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না’।
‘ও তো আমাকে দেবে, আমি তখন তোমাকে পাব কোথায়?’
‘আমাকে ওর ফোন নম্বর দেবে না তো, যদি ফেসবুকে কিছু লেখে’।
‘তোমার ফেসবুক নেই, তুমিও লিখবে। তবে একটা কথা কী জানো, মুখের খিস্তি মুখেই থাকে, কেউ লেখে না। ও তোমায় লিখবে না’।
‘আরে বাবা ও খিস্তি দেবে কেন? অন্য কথা, আজে বাজে কথা লিখবে’।
‘থানা-পুলিশ নেই। এক রাত্তির থানায় কাটালেই সব তেল মরে যাবে’।
হঠাৎ মানতাসা বলে, ‘তার চেয়ে তোমার একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিই। ফেক অ্যাকাউন্ট। তুমি সেখান থেকে আমার জন্য লড়বে’।
নারায়ণী হাঁ করে থাকে। ওর কোনও আপত্তি নেই। মানতাসা একটা অ্যাকাউন্ট খোলে। নামটা নারায়ণীই রাখে। শুধু তার বদলে একটা সুন্দরী মেয়ের ছবি। পাসওয়ার্ড হয় নারায়ণীদের কলোনি কালীতলার সঙ্গে মিলিয়ে কলতলা। সেখান থেকে দিকে দিকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো হয়। সুন্দরী মেয়ের ছবি। ঝপঝপ রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্টেড। প্রথম কয়েকদিন কাজে এলে মানতাসা ওর ফোনটা নিয়ে ওকে দেখায় গতকাল কী কী হল। নারায়ণী দু’তিন দিনের মধ্যে সড়োগড়ো হয়ে গেছে। আরও দু’চারদিনের মধ্যে ঝকঝকে। এখন রাতে লোনলি লেখে। চারদিক থেকে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানতাসার সেই বয়ফ্রেন্ডও এখন নারায়ণীর কবজায়। কত বাড়ির বাবুও এখন ফেসবুকে তার পায়ে লুটোপুটি খায়। মেসের ছেলে-ছোকরাগুলোও তার কমেন্টস চায়! বোঝো ঠ্যালা! নারায়ণী এটাকেও কলতলা ভাবে। এখানেও নারায়ণী রাতেভিতে বাসন মাজতে বসে। কিন্তু এখানে সে কল খোলে না। জলের ছর ছর শব্দ নেই। তাই খিস্তি নেই। তবে বাসন মাজা চলে। চারপাশটাকে নারায়ণী রগড়ে দেয়। রগড়াতে রগড়াতে ছাল চামড়া তুলে দেয়। কালি তোলে, পোড়া তোলে, হলুদ দাগ তোলে। সব কথা যে তার একার, তা নয়। পথে ঘাটে যা শোনে, তাকে ছেঁকে বুঝে সত্যি করে লেখে। অ্যাকাউন্ট ফেক। কথা নয়। ইদানীং অনেক মেয়ে বউও এখন তাকে ফলো করে। লাইক, কমেন্টস করে। একদিন নারায়ণী ওর প্রোফাইল পিকচার সরিয়ে সেখানে ঝাঁটা রাখল। খুব খারাপ। কিন্তু পাবলিক সয়ে গেল। অনেকে ভাবল ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযানে নারায়ণী নামল। কেউ কেউ বাঁকা কথা বলতে এসেছিল, নারায়ণী তাঁদের খিস্তি দিল। মা-মাসি তুলল না। বাপ ঠাকুরদা তুলল। মজা মারা ছেলে বুড়োরা ওর ঝাঁঝ সহ্য করতে না পারল না, সবাই নিশ্চুপে সরে গেল। ক্রমশ নারায়ণী তার সম্পর্কে দেওয়া যাবতীয় তথ্য পরিবর্তন করল একটু একটু করে। সেভেন পর্যন্ত পড়া স্কুলের নাম দিল। ড্যামের জলে ধুয়ে যাওয়া গ্রামের নাম দিল। মানুষের হেঁশেলের কথা, মানুষের কলঘরের ধুয়ে আসা কান্নার কথা ওর মতো আর কে জানে? সেগুলো লিখল। একদিন মানতাসা ওর মোবাইল থেকে নারায়ণী ওর পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করেছে। মানতাসা ওকে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে গিয়েও পাঠাল না। কেউ না জানুক, ও জানে নারায়ণী একজন ঠিকে ঝি বই আর কিছু না। তবে সে রোজই নারায়ণীর ওয়ালে ঘুরে যেত।
একদিন নারায়ণী দুটো ছবি পাশাপাশি একসঙ্গে পোস্ট করল। একটি সাদা কালো মেয়ের ছবি। গোল মুখ। দুদিক থেকে দুটো বিনুনি নেমেছে। মেয়েটা আকাশ ফাটিয়ে হাসছে। আর তার পাশে একটা অবাঞ্ছিত গর্ভরোধক ওষুধের ছবি। রঙিন! নীচে লেখাঃ আজ আমার আত্মঘাতী দিদির চল্লিশ বছরের জন্মদিন। আমি দিদিকে এই উপহারটা দিলাম। এবার তাকে আর লোকলজ্জার ভয়ে মরতে হবে না।
মানতাসা পোস্টটা দেখল। দেখে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, নারায়নীকে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল।
প্রকাশিত অদ্বিতীয়া ২০১৬, শারদবরণ ১৪২৩
ছবি এবং ইলাস্ট্রেশন- গুগল