গল্প।। অন্য আলোর গল্প ।। সৈকত ঘোষ

ভর দুপুরে উত্তর কলকাতার গলিগুলোয় একটা অদ্ভুত মায়া ছড়িয়ে থাকে। পুরোনো অন্ধকার আর নতুন আলো মিলেমিশে এক রহস্য-জ্যামিতি। মনে হয় হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া, যদি স্মৃতিদের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। চাদর সরে যায় সময়ের! অদৃশ্য কয়েকটা শব্দ, কিছু না বলা কথা জড়িয়ে ধরে আঙুল। সেই হাওয়ার মধ্যে কান পাতলে কোথাও ফেলে আসা পায়ের শব্দ শোনা যায়। দলা পাকিয়ে যায় মুহূর্তগুলো। কীভাবে দেখতে দেখতে তিন তিনটে বছর! মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা। বিয়ের প্রায় তিন বছর পর আবার এই গলিতে পা পড়লো স্বস্তিকার। ছোটোবেলা থেকেই হলুদ ট্যাক্সি ওর কাছে আলাদাই একটা প্রেম। এই ওলা উবেরের জমানাতেও সেই প্রেমে চিড় ধরেনি একটুও। উত্তর কলকাতার এই গলিগুলোর একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। আজও সেই গন্ধটা চিনতে ভুল হয় না স্বস্তিকার। ট্যাক্সিওয়ালা জিজ্ঞেস করে

– দিদি বাড়ির নম্বর ৩৯ তো?

-হ্যাঁ। তুমি এখানেই বাম দিকে সাইড করে দাঁড় করাও।

গরমটাও আজকে বেশ পড়েছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাতের রুমালটা দিয়ে কপালটা মুছে নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নামে স্বস্তিকা।

-দিদি আপনার ট্রলিটা ডিকি থেকে বের করে দিয়েছি। আমি ভেতরে পৌঁছে দেবো। ট্যাক্সিওয়ালা জিজ্ঞেস করে…

-স্বস্তিকা কিছু একটা ভাবছিল, আনমনেই বললো না থাক। আমি পারবো।

৩৯ শ্যামবাজার স্ট্রিট। একটা বেশ পুরোনো বড়ো সাবেকি কাঠের দরজা সামনে দাঁড়িয়ে। মুঠো শক্ত করলে যেভাবে বলি ঝরে যায়, সময়ের এক একটা পিক্সেল যেন হাত থেকে গড়িয়ে পড়লো চার দিকে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দরজাটাকে ছুঁয়ে হয়তো নিজের ফেলে আসা সময়টাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে থাকে স্বস্তিকা। হয়তো এভাবেই বারবার শিকড়ের কাছে ফিরে আসতে চায় মানুষ। কলিংবেলটা টেপার আগে প্রথম ফোনটা করে অ্যানিকে। অ্যানি ওর ছোটোবেলার বন্ধু, প্রাইমারি স্কুল থেকে। সেই হিসেবে দুজন দুজনের ক্রাইসিস ম্যানেজার।

– শোন অ্যানি, আমি পৌঁছে গেছি। এই তো জাস্ট। তোরা কিন্তু লেট করিস না। আর প্লিজ ওদেরকে একটু জানিয়ে দিস। আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবো মেরি মা। হ্যাঁ মনে আছে ফাইভ থারটি। ইটস ওকে। নারে বাবু কোনও অসুবিধা হবে না। হলুদ ট্যাক্সি আছে তো! ভুলে যাস না এভাবেই তো লাস্ট ওয়ান ইয়ার সিঙ্গাপুরে কাটিয়ে দিলাম। আর এটা তো আমার শহর। নিজের বাড়ি। বাড়িতে তো মানুষ এমনিই চোখ বন্ধ করে চলে…

কান থেকে ফোনটা নামিয়ে কলিংবেলটা টেপে স্বস্তিকা ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে’। কলিংবেলে রবীন্দ্রসংগীত। না বাড়ির টেস্ট একটুও বদলায়নি। রাজত্ব না থাক, দেব বাড়ির রক্ত বলে কথা। কুঞ্জকাকা দরজা খুলে দিলেন। স্বস্তিকা দু-পা এগোতেই হাতটা ধরলো মা। কারও মুখে কোনও কথা নেই। এভাবে কখনও মায়ের সামনে এসে দাঁড়াতে হবে ভাবেনি স্বস্তিকা। মাও কি ভেবেছিল কোনও দিন।

-চল ভেতরে। আগে একটু ফ্রেশ হয়ে নে। এতক্ষণের ফ্লাইট তারপর আবার এই দুপুর রোদে এতটা ট্যাক্সিতে। জ্যাম ছিল নাকি রাস্তায়?

-না সেরকম না। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল স্বস্তিকা কিন্তু কথা সরলো না মুখ দিয়ে।

পা দুটো এগোচ্ছে, কিন্তু চারদিকের অন্ধকারটা কিছুতেই কাটতে চাইছে না। আজ বাবাও এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখলেন। নিচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো স্বস্তিকা। দেব বাড়ির রেওয়াজ। প্রাণ যেতে পারে কিন্তু মান নয়।

– খেয়ে ওপরে ওঠ। তোর ঘরটাই কুঞ্জকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে রেখেছি। এই তিন বছরে তো ওঘরে কেউ যায়নি। আর গত ডিসেম্বর থেকে তোর ভাইও ব্যাঙ্গালোর। ওপরটা ফাঁকাই থাকে।

স্বস্তিকা কি বলবে কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। তবে শুনতে ভালো লাগছিলো। কতো বছর পর আবার মায়ের গলা। একটু বেশিই কি ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে ও। খেয়ে দেয়ে মা পৌঁছে দিয়ে এলো ঘরে। কুঞ্জ কাকা সুন্দর করে পরিষ্কার করে ধূপ জ্বালিয়ে রেখেছে। দক্ষিণের জনলাটার সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো স্বস্তিকা। এখনও কি ভোর হলে পাখিরা আসে…এখনও কি এখান থেকে রাস্তাটা দেখা যায়। এই তিন বছরে শুধু স্বস্তিকা নয়, ওর ফেলে যাওয়া শহর কলকাতাও বদলে গেছে অনেক। মা ফোনে বলছিল পাশের বাড়িটা ভেঙে হাউসিং হবে। ভেতরে সুইমিং পুলও থাকবে তাতে। ডান দিকের দেয়ালটায় এসে আবার থমকে দাঁড়ায় স্বস্তিকা। এখানেই তো দেয়াল জুড়ে ওর মুহূর্তরা ছড়িয়ে আছে। কলেজ লাইফের সব ছবি আর সেলফি প্রিন্ট করে সারা দেয়ালটাকে সাজিয়ে ছিল একুশের বার্থডেতে। সেও আজ সাত বছর। মুহূর্তগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে খুব একা লাগে। মনে হয় সময়ের সুতোটা কেটে গেছে বহুদিন। আকাশটাও বদলে গেছে হয়তো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে নিজেকেই ঝাপসা লাগে। আজ কি তাহলে বৃষ্টি হবে! কতদিন প্রাণ ভরে ভেজেনি স্বস্তিকা। এখনও সেই দুপুরগুলোকে খুব মিস করে। সমুদ্র ওর কোলে মাথা রেখে কবিতা শোনাতো। মনে হতো একটার পর একটা ঢেউ যেন পায়ের পাতা ছুঁয়ে উড়ান লিখে দেবে। শব্দের মায়াবী ঠোঁট এক আলোকবর্ষ থেকে অন্য আলোকবর্ষে মুগ্ধতার জানলা খুলে দিতো। না কিছুই বলা হয়নি, অথচ অনেক কিছুই তো বলতে চেয়েছিল স্বস্তিকা। ঠিক সন্ধে নামার আগে একটা ভিড় বাসস্টপ যেভাবে স্বপ্নের রঙিন বেলুন হতে চায়, যেভাবে একা বালুচর খুঁজে যায় তার ছায়ার দোসর। অথচ সে স্বপ্ন পুরো হয় না, মাঝপথে থেমে যায় উড়ান। সমুদ্রও তো কিছু বলেনি কোনও দিন, হাওয়ায় যখন ওর চুলগুলো উড়তো মনে হয়েছে এবার হয়তো পাখিরা ডেকে উঠবে, অস্তিন থেকে উড়ে আসবে অপেক্ষার চিঠি। না কিছুই হয়নি তেমন। মাঝখান থেকে ঝড়ের মতো ওর জীবনে আসে রূপক, তারপর মাস্টার্স শেষ করে দুম করে বিয়ে। বাড়িতে মেনে নেয়নি, কাস্ট প্রবলেম। হাজার হোক দেব বাড়ি, রাজত্ব না থাক সমাজ তো আছে! তারপর তিন বছর আগে রূপকের সাথেই এক বিকেলে ওর পাকাপাকি সিঙ্গাপুর চলে যাওয়া। আজ হঠাৎ করে সময়টা পেছন দিকে হাঁটছে। না লেখা অক্ষরগুলো জড়িয়ে ধরছে আঙুল। চারিদিকে একটা গুমোট ভাব। আকাশ ভারি হচ্ছে। স্বস্তিকা চশমাটা পরে নেয়। সাইডব্যাগে কয়েকটা চকলেট ভরে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

অ্যানি ফোন করে সমুদ্র আর সুদীপ্তকে।

-মনে আছে তো? তোরা লেট করিস না কিন্তু। হ্যাঁ, স্বস্তিকা পৌঁছে গেছে। হুম আমার সঙ্গে এই একটু আগেই কথা হলো।

ফোন দুটো সেরে চটপট একটু খেয়ে নেয় অ্যানি। ঘড়িতে বিকেল সাড়ে চারটে। এবার রেডি হতে হবে। একটা ফ্লোরাল প্রিন্ট টপ আর জিন্স পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। হালকা লিপস্টিক আর একটু আইলাইনার। না বয়সের বিন্দুমাত্র ছাপ পড়েনি, এখনো দিব্বি কলেজগার্ল বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। নিজের মনেই একটু হাসে অ্যানি। কত বছর পর আবার চারজন একসঙ্গে হবে! বেশ থ্রিলিং লাগে। কতো জমে থাকা কথা, কতো অভিমান। কলেজ লাইফে কফিহাউসে ওদের আড্ডাটা ছিল এপিক। কতো গান তৈরি হয়েছে। কতো বিকেল গড়িয়ে সন্ধে, সন্ধে গড়িয়ে রাত। কতো বিতর্ক, রাজনীতি থেকে সাহিত্য গানবাজনা কি না ছিল টপিক। এমন কি টপিক ছাড়াও ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত। কলেজের ক্যান্টিন হোক বা গঙ্গার ঘাট, ময়দান হোক কিংবা ভর দুপুরে বইপাড়া- স্মৃতিরা কেমন যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। ওদের ব্যান্ডটাও সেই সময় দারুণ পপুলার হয়। সমুদ্র লিখতো সুদীপ্ত গিটার, কতো গান গেয়েছে অ্যানি। স্বস্তিকা ছিল ওদের ম্যানেজার। কি সব শো ধরে আনতো। এখনও ভাবলে বেশ মজা হয়। সময় কি তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়! নাকি সবই থাকে শুধু আলোয় আলোয় ঢাকা পড়ে যায়। এসব ভাবতে ভাবতেই কানে ইয়ারফোন গুঁজে বেরিয়ে পড়ে অ্যানি।

ময়দানে ওদের পছন্দের গাছটার নিচে এসে দাঁড়িয়েছে স্বস্তিকা। চোখে কালো চশমা হাতে ব্লাইন্ড স্টিক। এখান থেকে মনে হয় যেন আকাশে মিশে গেছে ট্রামলাইন। কিছুটা দূর থেকে অ্যানি সুদীপ্ত আর সমুদ্র হেঁটে আসছে এদিকেই। স্বস্তিকা অনুভব করে চেনা স্পর্শ। সময় যেন ডায়লগ ভুলে গেছে। সবকিছু ব্ল্যাঙ্ক। মনের মধ্যে গেয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ ‘অন্তরে আজ দেখবো যখন আলোক নাহিরে’। স্বস্তিকার চোখের সামনে থেকে অন্ধকার পর্দাটা দ্রুত সরে যাচ্ছে, আলো এতো আলো…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *