দুটি অতৃপ্তি ।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ।।

উকিলের ছেলেকে উকিল হতেই হবে? আজকাল অবশ্য উকিল বলে না কেউ, ল-ইয়ার। অ্যাটর্নি কথাটাও শুনতে ভালো। কিংবা লন্ডন ঘুরে এসে ব্যারিস্টার। সে অবশ্য পরের কথা।

যে কারণে ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার হয় সাধারণত, সেই কারণেই উকিলের ছেলে উকিল হলে প্রথম থেকেই অনেক সুবিধে পাওয়া যায়। পশার জমাবার জন্য গোড়া থেকে লড়তে হয় না।

স্কুল বয়েস থেকেই প্রমিতের ইচ্ছে ছিল নিউক্লিয়ার ফিজিক্স পড়ার, কিন্তু বাবার প্রবল প্রতাপ, তাঁর ইচ্ছের ওপর কিছু বলা যায় না। সায়েন্সের বদলে পড়তে হল কমার্স, গ্র্যাজুয়েশনের পর ভর্তি হতে হল ল-ক্লাসে।

বাবা আর তপন জেঠুর ল-ফার্মের নাম ওগলভি, চ্যাটার্জি অ্যান্ড দাশ। আগে ওগলভি নামে একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পার্টনার ছিল, এখন আর নেই, তবু নামটা রেখে দেওয়া হয়েছে। সেই ফার্মে প্রমিত এখন অ্যাপ্রেনটিস। বাবা যদিও মালিক, কিন্তু প্রমিতকে কাজ শিখতে হচ্ছে হাতে-কলমে। অন্য কর্মচারীদের সঙ্গে সে বসে, মাত্র আড়াই হাজার টাকা মাইনে পায়। সকাল সাড়ে ন’টার সময় হাজির হতে হয়, সাড়ে পাঁচটার আগে ছুটি নেই।

তিন মাস চোদ্দ দিন হয়ে গেল, এর মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠেছে প্রমিত। এতক্ষণ বন্দি হয়ে থাকতে হয় অফিসে। পুরনো ফাইল ঘেঁটে কেস স্টাডি করতে হয়, এক একটা ফাইলে যা ধুলো! ডাস্ট অ্যালার্জি আছে তার।

এক একদিন সকালে আর যেতেই ইচ্ছে করে না। বাবার তুলনায় মা অনেক নরম, মায়ের কাছে মনের কথা বলা যায়। কিন্তু মা-ও এই ব্যাপারে কোনও সাহায্য করতে পারেন না। সামান্য হেসে বলেন, “তোর বাবার কাছে ছুটি চেয়ে দেখ না। অন্তত এক বছরের আগে কি কেউ অফিসে ছুটি পায়?”

মাঝে মাঝে দিদিমা এসে থাকেন এখানে। তিনিও বলেন, “কিছুদিন তো কষ্ট করতে হবেই রে বাপু। এরপর বিলেত যাবি, বিলেত ফেরত সাহেব হয়ে ফিরবি। তখন চাপরাশি তোর জুতো পরিয়ে দেবে।”

বিলেত মানে লন্ডন। আগেকার লোকেরা লন্ডনকে বিলেত বলে কেন? বিলেত মানে কী? প্রমিত জানে না, কাউকে জিজ্ঞেস করেও ঠিক উত্তর পায়নি। ছোটমামা বলে, “ওই তো, ইয়ে, বিলেত মানে সাহেবদের দেশ।”

তা হলে ফ্রান্স কিংবা জার্মানিকেও কেন বিলেত বলে না, সেখানকার লোকেরাও তো সাহেব!

ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টার হয়ে এলে চাপরাশিরা জুতো পরিয়ে দেবে, এ কথা শুনলেও প্রমিতের হাসি পায়। ব্যারিস্টাররা নিজে নিজে জুতো পরতে ভুলে যায় বুঝি?

বাবা মাঝে মাঝেই দিল্লি কিংবা ম্যাড্রাস যান। তখনও প্রমিতের অফিসে কাট মারার উপায় নেই। বাবা কিরণবাবুকে বলে দিয়েছেন প্রমিতকে কাজ শেখাতে। তিনি প্রমিতের ওপর সবসময় নজর রাখেন। বাবা বাইরে থেকে ফিরে এলে কিরণবাবু সব রিপোর্ট দেন। প্রমিত জানে।

দুপুরবেলা কিছুক্ষণের জন্য বেরনো যায়। বাড়ি থেকে দিয়ে দেয় টিফিন, অফিসের মধ্যেই তৈরি হয় চা-কফি, তবু প্রমিত একটুক্ষণ বাইরে ঘুরে আসে।

এই সময়টা ডালহৌসি স্কোয়্যারে যেন হট্টমেলা বসে যায়। কিছু কিছু রেস্তোরাঁ তো আছেই। এছাড়া সব রাস্তার ধারে ধারে আজস্র ফুড স্টল। বেশ কয়েক হাজার অফিসবাবু একসঙ্গে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসে খাবার খেতে শুরু করে।

প্রমিতের মতন ছেলেদের এসব রাস্তার খাবার খেতে নেই, সেই জন্যই বাড়ি থেকে খাবার আসে। প্রমিত অবশ্য মাঝে মাঝে ফুচকা আর আলুকাবলি খেয়ে ফেলে। রাস্তার ফুচকার মতন ভালো স্বাদ কি বাড়িতে হয় নাকি!

দুপুরবেলা বেরিয়ে প্রমিত একজন ফুচকাওয়ালার সামনে দাঁড়িয়েও কী ভেবে একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়ল। বাসটা মৌলালি পর্যন্ত পৌঁছে ডান দিকে বেঁকছে, সে নেমে পড়ল মোড়ের মাথায়। আর একটা বাস ধরল সিআইটি রোডের। এবার সে নামল হাসপাতাল ছাড়িয়ে পরের স্টপে।

একটা গলির মধ্যে ঢুকেই চোখে পড়ে একটা পুরনো আমলের বড় বাড়ি। সদর দরজাটা দুপুরবেলা বন্ধ থাকে। দেড়টা থেকে চারটের মধ্যে কারোকে ভেতরে যেতে দেওয়া হয় না। প্রমিত সেই সদর দরজা পেরিয়ে চলে গেল।

বাড়িটা যেখানে শেষ হয়েছে, তার পরেই একটা সরু গলি। এটা ব্লাইন্ড লেন। শেষ হয়েছে একটা কারখানা গেটে। সে কারখানা অনেক কাল বন্ধ, তাই এই গলিতে সচরাচর কেউ যায় না। প্রমিত গলিতে ঢুকেই একতলার একটা ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে জানালাটা খোলা। ভেতরের দেওয়ালে র‍্যাক ভর্তি বই, একটা গোল টেবিল, কয়েকটা চেয়ার। জানালার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে আছে একটি মেয়ে।

খুব মন দিয়ে সে খাতায় কিছু একটা লিখছে। টেবিলে তিন-চারটে মোটা মোটা বই খোলা। এসব বাড়িতে এখনও জানালায় গ্রিল নেই, আছে লম্বা লম্বা শিক। বেশ মজবুত। প্রমিত সেই শিক ধরে নির্নিমেষে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল, কোনও শব্দ করল না।

মেয়েরা কি মাথার পিছন দিক দিয়েও দেখতে পায়? কিংবা গন্ধ পায় পুরুষদের? হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে তাকাল মেয়েটি, সামান্য একটু চমকে বলল, “কে?”

প্রমিত কোনও উত্তর দিল না। দু’জনে তাকিয়ে রইল পরস্পরের চোখের দিকে। নিঃশব্দ। কত মিনিট কেটে গেল কে জানে। এমন একটা কিছু জামা পরে আছে মেয়েটি, যাতে পিঠের অনেকখানি খোলা। ঘাড় পর্যন্ত চুল, তার নীচে নামেনি। ঘি রঙের পিঠ, তাতে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

একসময় মেয়েটি কৃত্তিম কোপ দেখিয়ে, ভ্রু তুলে বলল, “অফিস পালিয়ে আসা হয়েছে?”

এবারে প্রমিত বলল, “একেবারে পালাইনি। এখন টিফিন টাইম।”

মেয়েটি বলল, “অত দূর থেকে… কেন?”

প্রমিত বলল, “কোনও কারণ নেই। এমনিই!”

মেয়েটি ঠোঁট টিপে হেসে বলল, “বোকারাম, বলতে হয়, তোমাকে দেখার জন্য এসেছি, তিন দিন না দেখে বুক ফেটে যাচ্ছে।”

প্রমিত বলল, “ঠিক তোমাকে নয়। তোমার পিঠ। তোমাকে পেছন দিক দিয়ে তো বিশেষ দেখা হয় না। জিনি, একবারটি এদিকে এসো।”

জিনি বলল, “পিঠস্থান দেখা হয়ে গেছে। এবার কাটো।”

প্রমিত বলল, “এক মিনিট, শুধু একবার…”

জিনি উঠে দাঁড়াল। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরা, ওপরের জামা ও সেই প্যান্টের মাঝখানে চার-পাঁচ আঙুলের ফাঁক। এ মেয়ে নাচতে জানে, সে কারণে তার কোমরে একছিটেও মেদ নেই। তার বন্ধুরা এক হিন্দি ফিল্মের নায়িকার সঙ্গে তার কোমরের তুলনা দেয়।

সে উঠে দাঁড়িয়েছে, জানালার কাছে আসবার জন্য নয়, বরং আর একটু দূরের একটা শেলফ থেকে একটা বই নামাবার জন্য। কিংবা এটা মেয়েদের এক ধরণের লীলা।

প্রমিত বলল, “প্লিজ, একবার এসো…”

জিনি মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলতে লাগল, “নো স্যার-র-র! চারদিন বাদে আমার লাইফ অ্যান্ড ডেথ পরীক্ষা, এখন আমার আড্ডা মারার সময় নেই। যাও, অফিসে যাও, মন দিয়ে কাজ করো।”

“বলছি তো, মাত্র এক মিনিট, শুধু এখানে এসে দাঁড়াবে।”

“কেন, ওখানে গিয়ে দাঁড়ালে কী হবে?”

“চুমু খাব না। শুধু তোমার গায়ের একটু গন্ধ শুঁকব।”

“হেঃ। আমার গায়ে এখন শুধু ঘামের গন্ধ।”

“আঁদ্রে জিদ লিখেছেন, ঘামের গন্ধই ভালো সেক্স অ্যাপিল।”

“ও-সব ফরাসি দেশে হয়। ওদের তো সহজে ঘাম হয় না, খুব রেয়ার। আমাদের দেশে তো সারা বছরই ঘাম, বিচ্ছিরি!”

এইরকম কথা চলল কিছুক্ষণ। জিনি কিছুতেই কাছে এল না। একসময় বাড়ির ভেতর থেকে কে যেন ডাকল জিনির নাম ধরে।

জিনি চোখ বড় বড় করে, ভয় দেখানোর ভঙ্গিতে বলল, “দা-দা!”

সঙ্গে সঙ্গে জানালার কাছ থেকে সরে গেল প্রমিত। বেশ জোরে জোরে হেঁটে বড় রাস্তায় পড়ে, একটা প্রায় চলন্ত বাসে উঠে গেল। অফিসে কেউ কিছুই টের পেল না। পরদিন বেলা বারোটা বাজতে না বাজতেই ছটফটিয়ে উঠল প্রমিত। তাকে যেতেই হবে জিনির কাছে। যদিও যাওয়া তার উচিত নয়। ফলিত গণিতে এমএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে জিনি। তাকে ফার্স্ট ক্লাস পেতেই হবে। পাগলের মতন ভালো করে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে সে পড়াশুনো করে যাচ্ছে। এই সময় তাকে বিরক্ত করা অন্যায়। কিন্তু সে তো যুক্তির কথা।

তাছাড়া, আর একটা মুশকিল, এর মধ্যে জিনির দাদা বিক্রমের সঙ্গে প্রমিত ঝগড়া বাঁধিয়ে বসে আছে। দু’জনে বন্ধু ছিল একসময়। বাচ্চা বয়েসে খেলাধুলো করেছে একসঙ্গে। কলেজ জীবনের রাজনীতিতে দু’জনে দু’দিকে চলে যায়। তা সত্ত্বেও তো ভাব রাখা যায়। ছিলও। কিন্তু কফি হাউসে একদিন তর্কাতর্কি তুমুল হয়ে ওঠার পর প্রমিত হঠাৎ বিক্রমকে বলে উঠেছিল, “তুই একটা ইডিয়ট! ডান্ডারহেডের মতন কথা বলছিস।”

ইডিয়ট তবু চলে। কিন্তু ডান্ডারহেড খুব খারাপ গালাগাল। সত্তর-আশির দশকে বেশ চালু ছিল, এখন আর বিশেষ শোনা যায় না।

সেই গালাগাল শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বিক্রম বলল, “কী তুই আমাকে… শালা!”

সে মারতে গেল প্রমিতকে। অন্য বন্ধুরা অবশ্য মাঝখানে বাধা দিয়ে ছাড়িয়ে দিল ওদের। দু’জন বন্ধু প্রমিতকে টানতে টানতে কফি হাউসের বাইরে নিয়ে গেল। দু-একদিন পরে প্রমিত অনুতপ্ত হয়ে ঠিক করেছিল, সে বিক্রমের কাছে ক্ষমা চেয়ে মিটিয়ে নেবে। কিন্তু এর মধ্যেই অন্য বন্ধুরা তাকে শুনিয়ে গেল যে বিক্রম তাকে আরও নানারকম কুৎসিত গালাগালি দিচ্ছে, এমনকি পুলিশের স্পাই পর্যন্ত বলেছে। এর পর আর মিটমাট হবে কী করে? দু’জনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ।

 

প্রেমিকার দাদার সঙ্গে ঝগড়া করা নিতান্তই বোকামি। এর ফলে, প্রমিত আর ওদের বাড়িতে যায় কী করে?

জিনি অবশ্য বলেছে, “দাদার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বলে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে না কেন? তুমি আমার বন্ধু!”

তবু প্রমিত আর ও-বাড়িতে যায় না। জিনির সঙ্গে বাইরে এখানে-সেখানে দেখা হয়। এখন পরীক্ষার সময় জিনি বাইরে বেরোয় না।

আবার টিফিনের সময় প্রমিত চলে এল সেই গলির ধারে জানালায়। এবারে জিনি মুখ ফেরাতেই প্রমিত বলল, “তুমি পড়াশুনা করো। আমি তোমায় কোনও ডিস্টার্ব করব না। শুধু এখানে দাঁড়িয়ে একটুক্ষণ দেখব।”

জিনি বলল, “তা আবার হয় নাকি? এতে পড়ায় মন বসে?”

“আমি একটুও শব্দ করব না।”

“আমার রেজাল্ট খারাপ হলে কিন্তু তুমি দায়ী হবে।”

“পাঁচ মিনিট, ঠিক পাঁচ মিনিট।”

প্রমিত একটা সিগারেট ধরাল। জিনি মুখ না ফিরিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করছিল, এবার উঠে দাঁড়িয়ে করুণ মুখ করে বলল, “সিগারেটের গন্ধ পেলে… সত্যি আমার সব গোলমাল হয়ে আসছে।”

জানালার কাছে চলে এসে সে বলল, “ওটা আমাকে দাও। আমি একটা টান দেব।”

একটার বদলে দুটো টান দিল জিনি। সিগারেটটা ফেরত দিয়ে সে হঠাৎ প্রমিতের মাথায় হাত দিয়ে চুল এলোমেলো করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সরে গিয়ে বলল, “এবার যাও, লক্ষ্মীটি…”

প্রমিত আর দাঁড়াল না। হাঁটতে লাগল ফুরফুরে মেজাজে।

সিগারেটটাতে সে এখন অন্যরকম স্বাদ পাচ্ছে, এতে জিনির ঠোঁটের ছোঁয়া আছে। মাথার চুলে এখনও যেন জিনির স্পর্শ।

আবার পরের দিন ঠিক ওই সময় জানালার বাইরে প্রমিতের মুখ দেখে জিনি রীতিমতন রেগে গেল। পরীক্ষার আর মাত্র দু’দিন বাকি। এ সময় তার মনঃসংযোগ নষ্ট করা উচিত নয়।

কাঁচুমাচুভাবে প্রমিত বলল, “আজ ঘুম থেকে ওঠার পরেই একটা অদ্ভুত ইচ্ছে আমাকে চেপে বসেছে। কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারছি না। এক মিনিটের জন্যেও। কী করব, না এসে পারলাম না যে! জানি এটা অন্যায়।”

ঠান্ডা গলায় জিনি বলল, “অদ্ভুত ইচ্ছে? কী সেটা, শুনি?”

“বলব?”

“বলার জন্যই তো তুমি এসেছ?”

“রাগ করো না। হয়তো এটা আমার পাগলামি। ইচ্ছে করছে…”

“থামলে কেন, বলো।”

“ইচ্ছে করছে, তুমি একবার এসে এই জানালার কাছে, খুব কাছে এসে দাঁড়াবে। আমি তো গরাদের এপাশে। তাই আমি যেন একটা কয়েদি। একবার জিভ দিয়ে তোমার নাভিটা ছোঁব। তোমার নাভিতে আমি কখনও চুমু খাইনি।”

প্রায় এক মিনিট চুপ রইল জিনি। তার মুখ থেকে মুছে গেল রাগের ভাব। সে খুব নরম গলায় বলল, “এই ধরণের পাগলামিই আমার ভালো লাগে।”

এক পা এগিয়ে এসে আবার বলল, “আমি রাজি হতে পারি, যদি তুমি…”

দারুণ ব্যগ্রভাবে প্রমিত বলল, “বলো, বলো, তার বদলে আমায় কী করতে হবে?”

জিনি বলল, “আমার সিট পড়েছে বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে। পরীক্ষা শুরুর দিন ঠিক পৌনে দশটার সময় আমি ভেতরে ঢুকব। ঢোকার সময় একবার তাকাব পেছন ফিরে। রাস্তার উল্টোদিকে আমি কি প্রমিত সান্যালের মুখটা দেখতে পাব? তাহলে আমি সিওর ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হব।

প্রমিত বলল, “পৃথিবী যদি উল্টেও যায়, তা হলেও আমি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকব পৌনে দশটার সময়।”

জিনি আরও কাছে এগিয়ে এল। ব্লাউজটা উঁচু করল একটু। দেখা গেল তার নাভি, ঠিক পাতলা মেঘের আড়ালে চাঁদের মতো।

প্রমিত দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতে গেল তার কোমর।

ধরা হল না।

ঠিক তখনই একজন কেউ বলে উঠল, “এই হারামির বাচ্চা, তুই এখানে কী করছিস রে?”

মুখটা ফেরাতেই প্রমিত দেখল অদূরে একজন মস্তান দাঁড়িয়ে। পা ফাঁক করা, কোমরে হাত, গলায় রুমাল বাঁধা। দু’পাশে দু’জন স্যাঙাৎ!

প্রমিতের বুকটা কেঁপে উঠল। সিনেমায় এই সব পাড়ার মস্তানদের খুব দেখা যায়। মুহূর্তের ভগ্নাংশের মধ্যেই তার মাথায় খেলে গেল, এখান থেকে তাকে এক্ষুনি সরে যেতে হবে। এই মস্তানরা চিৎকার বা গালাগালি যা-ই করুক, এ বাড়ির কাছে যেন না হয়। যেন জিনি কিছু বুঝতে না পারে, ওর দাদা কিছু জানতে না পারে।

চট করে জানালার কাছ থেকে সরে গিয়ে সে মস্তানটিকে জিজ্ঞেস করল, “কী বলছেন? কী বলছেন?”

সে প্রমিতের জামার কলার চেপে ধরে বলল, “শালা, পাড়ার মেয়ের সঙ্গে লদকালদকি হচ্ছে? বেপাড়া থেকে এসে…”

প্রমিতের মাথায় তখন একটাই কথা ঘুরছে। এখান থেকে সরে যেতে হবে যেকোনও উপায়ে।

সে এক ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় লাগাল। সঙ্গে সঙ্গে মস্তানরা আনন্দে হই হই করে উঠল, কারওকে পালাতে দেখলেই তারা মজা পায়। প্রমিত যদি ওখানে দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ কথা চালিয়ে যেতে পারত, তা হলে হয়ত বিশেষ কিছু ঘটত না। বড়জোর দু-একটা চড়-চাপড়। এবারে তারা হই হই করে তাড়া করল প্রমিতকে।

প্রমিত বেশি দূর যেতে পারল না। ধরা পড়ার পর প্রমিত একটুক্ষণ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল। ওরা তিনজন, সে একা লড়বে কী করে? সে তো সিনেমার হিরো নয়। ভালো পরিবারের ছেলে, মারামারি করাও অভ্যেস নেই।

প্রচন্ড মারধর করে, প্রমিতের দুটো দাঁত ভেঙে, ডান হাতটা মুচড়ে দিয়ে ওরা একসময় তাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ রাস্তাতেই পড়ে রইল প্রমিত। তারপর এক বৃদ্ধ রমণী তার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “আহা রে…”

তখন আরও লোক জমল। প্রমিত একেবারে জ্ঞান হারায়নি। কোনওরকমে বলল, “দয়া করে একটা ট্যাক্সি ডেকে দিন…”

তার পর চৌত্রিশ বছর কেটে গেছে।

সে আমলে মোবাইল ফোনের কথা কেউ স্বপ্নেও জানত না। ল্যান্ড লাইনেও ফোন পাওয়া দুস্কর ছিল। ডান হাত প্লাস্টার করা, প্রমিতের লেখার ক্ষমতা ছিল না দেড় মাস। জিনির সঙ্গে প্রমিতের দেখা হয়নি এর মধ্যে।

উকিলের ছেলে উকিলই হয়। প্রমিত সান্যাল এখন ক্রিমিনাল কেসের বিখ্যাত ল-ইয়ার। বিলেত-আমেরিকা যায় প্রায়ই।

সে বছর ফলিত গণিতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল দু’জন। জিনি অর্থাৎ নীলাঞ্জনা ফার্স্ট হতে পারেনি, হয়েছিল সেকেন্ড। পরীক্ষার পর কিছুদিন সে ছিল দেরাদুনে মামার বাড়িতে। তার পর পিএইচডি করতে যায় ফিলাডেলফিয়ায়। বিয়ে হয়েছিল এক মার্কিনি অধ্যাপকের সঙ্গে। সে নিজেও অধ্যাপনা করে, দুটি সন্তানের জননী। আমেরিকার নাগরিক হয়ে গেছে কবেই। ভারতে বেড়াতে আসে মাঝে মাঝে। ফ্র্যাঙ্কফুট বিমানবন্দরে দেখা হল দু’জনের। চৌত্রিশ বছর পর। সেই প্রথম যৌবনে প্রেম ছিল। সে-সব ফিকে হয়ে গেছে। দু’জনের চেহারারও পরিবর্তন হয়েছে অনেক। প্রমিত বেশ মোটা হয়ে গেছে। ভারিক্কি চেহারাই সার্থক উকিলদের মানায়। কিছুদিন আগেও সে পাইপ টানত, এখন ধূমপান ছেড়ে দিয়েছে। জিনি সেরকমই ছিপছিপে আছে। চুল রঙ করে না, তাই সাদা সাদা ছোপ দেখা যায়। চোখে বেশি পাওয়ারের চশমা। তবু ফ্লাইট ধরার অপেক্ষায় বসে থাকার সময় দু’জনের চোখাচোখি হল। চিনতে একমুহূর্তও দেরি হল না।

প্রমিত ইতস্তত করছিল, জিনিই দূর থেকে উঠে এসে তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছো, উকিলবাবু?”

চৌত্রিশ বছর দেখা হয়নি, তবু দু’জনেই দু’জনের সম্পর্কে সব খবরই রাখে। মান-অভিমানের প্রশ্ন নেই, কোনও অভিযোগও নেই। জীবন তাদের অনেক দূরে দূরে স্থাপন করেছে। দু’জনেই এখন সার্থক, বেশ ব্যস্তও বটে। এখন অবশ্য হাতে কিছুটা সময় আছে। সহজভাবে গল্প করতে লাগল দু’জনে। পরস্পরের বাড়ির খবর। ছেলে-মেয়ের কথা।

যখন প্লেনে ওঠার কথা ঘোষণা করা হল, দু’জনে যাবে দু’দিকে, তখন জিনি আগে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “একটা মজার ব্যাপার শুনবে? জীবনে যে ক’টা পরীক্ষা দিতে হয়েছে, কিংবা কোনও সেমিনারে সিরিয়াস বক্তৃতা, কিংবা ইন্টারভিউ, আমার কেমন যেন ফিকসেশন হয়ে গেছে। আমি ভেতরে ঢোকার আগে রাস্তার উল্টো দিকে একবার তাকিয়ে দেখি, বিশেষ একজনের মুখ খুঁজি।”

প্রমিত বলল, “তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, আমি কোনও মেয়ের কোমরের দিকে তাকাই না। যদি দৈবাৎ কখনও চোখ পড়ে যায়, তখনই মনে হয়, জীবনে যেন কিছুই পাইনি।”

এই কথা বলার সময়, মোটাসোটা পৌঢ় বয়সী উকিলবাবুটি একজন ব্যর্থ প্রেমিকের মতন দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন।

*(অদ্বিতীয়া ম্যাগাজিন শারদবরণ ১৪১৯-এ প্রকাশিত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *